প্রথম পাতা

এ আমার দেশের সম্মান

কলকাতা প্রতিনিধি ও কূটনৈতিক রিপোর্টার

২৭ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:৩৫ পূর্বাহ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। দুই নেত্রী একান্তে কথা বলেছেন প্রায় আধঘণ্টা। এ সময় তাদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে তা কেবল তারাই বলতে পারেন। তবে শেষ সময়ে সফরসূচিতে যুক্ত হওয়া ওই বৈঠকে কি আলোচনা হয়- সেদিকেই তাকিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। কারণ মমতা ব্যানার্জির বাগড়ায় ২০১১ সাল থেকে ঝুলে আছে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। কলকাতার হোটেল তাজে সন্ধ্যার ওই বৈঠকটি সেরেই প্রধানমন্ত্রী এবং তার সফরসঙ্গীরা ঢাকার বিমানে ওঠেন। ফলে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি বৈঠকে স্থান পেয়েছে কি-না এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকার কোনো সূত্রই তা নিশ্চিত করেনি। তিস্তার বিষয়ে কোন আলোচনা হয়েছে কিনা? বৈঠক শেষে এ নিয়ে মমতার কাছে জানতে চেয়েছিলেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। কিন্তু মমতা তা এড়িয়ে যান। তিনি ইঙ্গিত করেন আগের দিনে শান্তি নিকেতনে দুই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা-মোদির বৈঠকের প্রতি।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সফরের দ্বিতীয় ও শেষদিনে শনিবার রাজ্যের আসানসোলে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি দেয়া হয়েছে। শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা গ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা ‘সমগ্র বাঙালি জাতিকে উৎসর্গ’ করার ঘোষণা দেন। বলেন- “এই সম্মান শুধু আমার নয়, এ সম্মান বাংলাদেশের জনগণের।” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ওই সমাবর্তনে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যাননি। সেখানে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।

সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হাসিনা-মমতা বৈঠক: সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে শনিবার কলকাতার একটি পাঁচতারকা হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক হয়। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে আপত্তি জানানোর পর কলকাতায় এটিই শেখ হাসিনা এবং মমতার প্রথম একান্ত বৈঠক। মমতা আগেই বলেছিলেন, হাসিনাদির সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভালো। শেখ হাসিনাও মমতাকে খুবই ভালোবাসেন। মমতার জন্য নিয়মিত উপহারও পাঠান তিনি। এবারও তিনি মমতাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ। গতকালের বৈঠককে মমতা সৌজন্যমূলক আখ্যা দিলেও দুই নেত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। মমতা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্ক বিশ্ববঙ্গের অংশ। কোনো সীমান্ত বা রাজনীতি এখানে কাজ করবে না। এদিনের আলোচনায় অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে নবান্ন সূত্র জানিয়েছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ব্যাপারেও দুই নেত্রীর মধ্যে কথা হয়েছে। বৈঠক শেষে মমতা বলেছেন, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক নিয়েও তাদের মধ্যে কথা হয়েছে। তবে মমতা মনে করেন, সম্পর্ক ঠিক রাখার দায়িত্ব দুই দেশেরই। সেই সঙ্গে মমতা জানিয়েছেন, দুই দেশের সরকার মত দিলে তিনি রাজ্যে বঙ্গবন্ধু ভবন তৈরি করবেন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে ভারত সরকার আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার খাতিরে তারা মমতাকে বারে বারে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাধ্যবাধকতার কথাও তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মমতা তার আগেকার অবস্থানেই অনড় রয়েছেন। তিনি মনে করেন, তিস্ত্তাতে এখন পর্যাপ্ত পানি নেই।

ডি লিট সম্মান পেয়ে অভিভূত হাসিনা: পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় কবির জন্মদিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডি লিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে। এই সম্মান পেয়ে তিনি যে অভিভূত, একই সঙ্গে গর্বিত, সেটি তার ভাষণেই উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সমাবর্তনে শেখ হাসিনার হাতে এই সম্মাননা তুলে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাধন চক্রবর্তী। এদিনের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন না। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠিও অসুস্থতার কারণে সমাবর্তনে উপস্থিত হতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাধন চক্রবর্তী সমাবর্তনে স্বাগত ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এবং গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই উপাধি দেয়া হয়েছে। সম্মাননা গ্রহণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলামের নামে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননা গ্রহণের জন্যই ছুটে এসেছি। তিনি বলেছেন, বাংলা ভাগ হয়েছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কখনো ভাগ হবে না। তিনি বলেছেন, নজরুল এখানে জন্মেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি বলেছেন, কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। আমরা সেই চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে গড়ে তুলছি। মানব কল্যাণে নজরুল যে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জুগিয়ে যাবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য ভারতের মানুষের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি চেষ্টা করে চলেছেন। আর এ ব্যাপারে সব সময় তিনি ভারতকে পাশে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এই উপমহাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত দেখতে চাই। আর তাই মানবতার কথা বেশি করে ভাবি। এই প্রসঙ্গেই তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কথা উল্লেখ করেন। কবি নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি এবং কবির গ্রাম চুরুলিয়ার সংস্কারের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। গত শুক্রবার শেখ হাসিনা দু’দিনের পশ্চিমবঙ্গ সফরে রাজ্যে এসেছেন। শুক্রবার শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন এবং বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এদিন বিকেলে জোড়াসাঁকোতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মগৃহসহ ঠাকুরবাড়ি ঘুরে দেখেন। দেখেন রবীন্দ্র মিউজিয়ামও। সেখানে বাংলাদেশের গ্যালারি রূপায়নের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। মিউজিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া পদ্মার বোটের অনুকৃতিটিও তিনি ভালো করে দেখেন। পরে মন্তব্য বইতে তার মতামত লিপিবদ্ধ করেন। শনিবার তিনি এলগিন রোডে নেতাজির বাড়িতে গিয়ে এই বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শেখ হাসিনার নেতাজি ভবন পরিদর্শন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বসতবাড়িতে অবস্থিত নেতাজি মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। এই সময় তার সঙ্গে ছিলেন বোন শেখ রেহেনা। নেতাজি ভবনে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান নেতাজি পরিবারের বৌমা সাবেক সাংসদ কৃষ্ণা বসু ও তার পুত্র সুগত বসু। প্রধানমন্ত্রী নেতাজি মিউজিয়ামটি ঘুরে ঘুরে দেখেন। এ সময় নেতাজির প্রতি তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজানো হয়েছে, ১৯৭২ সালে নেতাজির জন্মদিনে তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত বঙ্গবন্ধুর বার্তা। এই নেতাজি ভবনেই শেখ হাসিনাকে উপহার হিসেবে দেয়া হয় দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের দিনে মান্দালয় জেলে কারারুদ্ধ নেতাজির গানের খাতার প্রথম পাতাটি। এই পাতাটিতে লেখা ছিল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সেই গানের খাতা আজও নেতাজি মিউজিয়ামে যত্নে রাখা রয়েছে। এই পাতাটি ১৯৭২ সালে ফ্রেমে বাঁধিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও উপহার দিয়েছিলেন নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসু। এবার দেয়া হলো তার কন্যাকে। কৃষ্ণা বসু ও সুগত বসু পুরো মিউজিয়ামটি শেখ হাসিনাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। উল্লেখ্য, নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বসুকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যুবা বয়সে কলকাতায় ছাত্র থাকা অবস্থায় কীভাবে নেতাজির ডাকে হলওয়েল মনুমেন্ট বিরোধী আন্দোলনেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। আর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় এলগিন রোডের বাড়িটিও ফের হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের রঙ্গভূমি। এই বাড়ি থেকে নানা কাজ ছাড়াও যশোরে নেতাজি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন চিকিৎসক শিশির বসু। রেহেনা আগেও নেতাজি ভবন পরিদর্শন করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রথম নেতাজি ভবন পরিদর্শন করলেন।
বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান: এদিকে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের যৌথ উদ্যোগের সুবিধা দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দু’দিনের পশ্চিমবঙ্গ সফরের প্রথম দিনে শুক্রবার কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেই বৈঠকেই বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের বিনিয়োগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, উভয় দেশের স্বার্থে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগে, বিশেষ করে যৌথ উদ্যোগের সুবিধা দেয়া দরকার।

বৈঠকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নদী খননে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ আশা করে বলেন, এতে আঞ্চলিক যোগাযোগ আরো জোরদার হবে। এই বৈঠকে শেখ হাসিনা ছিলেন বেশ খোশ মেজাজে। বৈঠকে উপস্থিত ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট আবদুল মতলুব আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিমবঙ্গের এক শিল্পকর্তা ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, এই গানটির দুটি পঙ্‌ক্তি বলেছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, আর তিস্তাকে বাদ দিলেন? এই রসিকতার অবশ্য অন্য কোনো মানে খোঁজা ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন মতলুব। এদিন রাতে রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরী নাথ ত্রিপাঠির দেয়া ভোজসভায় যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status