শেষের পাতা

রোহিঙ্গা সংকটের ৯ মাস

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ

কূটনৈতিক রিপোর্টার

২৭ মে ২০১৮, রবিবার, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন

২৫শে আগস্টে আচমকা রোহিঙ্গা ঢলের ৯ মাস পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে সংকট সামাল দেয়ার চেষ্টায় দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে ঢাকা। সীমান্ত খুলে দেয়া, না দেয়া নিয়ে খোদ সরকারের ভেতরেই নানা মত ছিল। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে কেবল সীমান্তই উন্মুক্ত হয়নি, হৃদয়ও খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। সমালোচকরা এখন মানছেন- বর্মী নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে সীমান্তে জড়ো হওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নারী-শিশু-বৃদ্ধদের সেদিন আশ্রয় না নিলে অনেকে ওখানেই মারা পড়তো। এ নিয়ে বিতর্কের পক্ষ-বিপক্ষ তথা গোটা বাংলাদেশের এখন একটাই চাওয়া যেকোনো মূল্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা লাঘব, অন্য কিছু নয়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং প্রত্যাবাসন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সেদিন এক আলাপে বলেন- মাছ আর মেহমান, এটা সারা দুনিয়াতেই সমাদৃত। কিন্তু এ থেকেও তৃতীয় দিনে গন্ধ বের হয়! উপদেষ্টার কথায় মানবতার প্রতি দায় থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে গোটা জাতি। কিন্তু এ সংকটের সমাধান একটাই তা হলো- তাদের টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। এটাই এখন বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের চেয়ে তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি ভিন্নমত পোষণকারীদের বক্তব্য হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন চেষ্টার অভিযোগে মিয়ানমারের ওপর বহুপক্ষীয় চাপ যখন তুঙ্গে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন পুঞ্জিভূত এ সংকটের সমাধানে সুচি সরকারকে প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দ্বারপ্রান্তে ছিলেন ঠিক তখনই আচমকা দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি সই করে ফেলে বাংলাদেশ। এ নিয়ে খোদ মন্ত্রণালয়ের পেশাদার কূটনীতিকরাও গররাজী ছিলেন। পররাষ্ট্র সচিব বা মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতও এত দ্রুত চুক্তিটি সইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে মন্ত্রী নেপি’ডতে চুক্তি সই করেই ঢাকায় ফিরেন। নভেম্বরে অনেকটা তড়িঘড়ি করে বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের ফেরানো সংক্রান্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট সই হয়। পরবর্তীতে এর আওতায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ এবং ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সই করা সহ আরো অনেক কাজ করতে হয়েছে। চুক্তিতে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও আজ অবধি (৬ মাসেও) তা হয়নি। চিঠি চালাচালি আর বৈঠক, বক্তৃতা-বিবৃতিতে আটকে গেছে আকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবাসন। এখনো এর কোনো দিন-তারিখ নেই। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল মিয়ানমারের তরফে গণমাধ্যমে প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে এ নিয়ে কোনো আলোচনা আছে কি? জবাবে মন্ত্রী বলেন-না। আমাদের কাছে কোন দিন-তারিখ নেই, তবে আমরা আশাবাদী এটি হবে। প্রত্যাবাসন একটি জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়া উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমরা অতীতে অনেককে ফেরত পাঠিয়েছি। এবারো পারবো। আমি আশাবাদী। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না।
আইসিসিতে অভিমত পাঠাতে ভিন্নমত-দ্বিধা: এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার অভিযোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) অভিমত পাঠাতেও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভিন্নমত ও দ্বিধা কাজ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে নাকি আন্তর্জাতিক চাপে রেখে এর সুরাহা হবে, এ নিয়ে শুরু থেকেই সরকারের মধ্যে একাধিক মত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আইসিসিতে মতামত পাঠানো নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক (জাতিসংঘ) ডা. সাদিয়া ফয়জুন্নেচ্ছা মানবজমিনকে বলেন, পররাষ্ট্র সচিবের নির্দেশনা মতে মতামত পাঠানোর প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে দ্রুতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। আইসিসিতে অভিমত পাঠানোর বিষয়ে গত বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন- আমরা বিষয়টি দেখছি, দেখি কী করা যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নৃশংসতার ব্যাপারে তদন্ত শুরুর আগে বাংলাদেশের অভিমত জানতে চেয়েছে আইসিসি। চলতি মাসের ৭ তারিখ আইসিসির প্রাক?-বিচারিক শুনানিতে তদন্তের বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে অভিমত চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বাংলাদেশকে এ নিয়ে আগামী ১১ই জুনের মধ্যে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে অভিমত পাঠাতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানায় সংঘটি। কূটনৈতিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, শুরুতে এ বিষয়ে অভিমত পাঠাতে আগ্রহী ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু চীন ও জাপান দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জোর দেয়ায় আইসিসিতে পর্যবেক্ষণ পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ দ্বিধায় পড়ে গেছে। এবারের রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে দ্বিপক্ষীয় সমাধানে মধ্যস্থতা করছে চীন। এ সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ না করতে চীনের তরফে অনুরোধ রয়েছে।

চীনের পর ইদানীং জাপানও একই পথে হাঁটছে। দেশটি বলছে, বাংলাদেশকে এ সমস্যা মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানে মনোযোগী হতে হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-বিষয়ক বিশেষ দূত সান গুয়োশিয়াং মিয়ানমারের পর বাংলাদেশ সফর করেছেন। গত মঙ্গলবার তিনি নেপিডোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির সঙ্গে বৈঠকের পর ঢাকায় আসেন। সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাও করেন। চলতি বছর এ নিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো ঢাকা সফর করলেন। টোকিওর কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর টোকিও সফরের সময় মিয়ানমারকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের বিষয়টিতে জাপান জোর দিয়েছে। সূত্র মতে, সরকারের কেউ কেউ মনে করেন, আন্তর্জাতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত চাপ দেয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। আবার অনেকের মত হচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রেখে বাংলাদেশকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আইসিসি বাংলাদেশের মতামতের ব্যাপারে যে অনুরোধ জানিয়েছে, তাতে ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত বলে মনে করেন পেশাদাররা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status