শেষের পাতা

পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে বেকায়দায় এনসিটিবি

নূর মোহাম্মদ

২৪ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

প্রাক্কলিত দরে বিনামূল্যের ৩৬ কোটি পাঠ্যবই নিয়ে সংকট দিনদিন ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচনী বছর তাই সরকারের সফল এ প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়েই দুই মাস আগে অক্টোবরে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার  সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ঘাপলা পাকিয়েছে খোদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অভিযোগ উঠেছে প্রাথমিকের পর্যায়ে সাড়ে ১১ কোটি বইয়ের কাজ বিদেশি কয়েকটি  প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দিতে টেন্ডার বাতিল করে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করেছে সংস্থাটি। এতে প্রায় দুই মাস দেরিতে কাজ শুরু করতে হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন টেন্ডারে প্রাক্কলিত দরসহ অন্যান্য তথ্য দিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে এনসিটিবি’র বিরুদ্ধে। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহ চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহার কক্ষে দুই ঘণ্টা ব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয় বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। গোপন এ বৈঠকের বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। গতকাল দিনভর চেয়ারম্যানসহ এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সত্যতা মিলেছে। এ ছাড়াও মাধ্যমিক ও একাদশের বই নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।  
গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি স্বীকার করে একজন সদস্য মানবজমিনকে বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে গোয়েন্দারা জানতে চেয়েছেন। আমার বিষয়টি জানা নেই, এটা তাদের জানিয়ে দিয়েছি। এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য প্রফেসর মিয়া এনামূল হক রতন সিদ্দিকী মানবজমিনকে বলেন, বই নিয়ে যেসব সংকট তৈরি হয়েছে তার কারণ জানতে চেয়েছে গোয়েন্দারা। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এনসিটিবির বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা বিষয়টি জানতে চেয়েছে। আমি যেহেতু এ ধরনের বৈঠক করেনি তাই আমি জানি না বলে তাদের জানিয়ে দিয়েছি। এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র সাহা বলেন, এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। কাউকে কোনো বিশেষ সুযোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দরপত্রের সিডিউল ও পিপিআর অনুযায়ী ঠিকাদাররা বিট করেছে তারাই কাজ করবে।
জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক তিনটি বই ছাপার কাজ করে এনসিটিবি। প্রায় স্তরের বই নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রাক্কলনের চেয়ে প্রাথমিকের প্রায় ১১ কোটি বইয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো টেন্ডার বাতিল করে নতুন টেন্ডার আহ্বান করেছে এনসিটিবি। প্রাক-প্রাথমিকের দরপত্র খোলা হবে ২০শে জুন আর প্রাথমিকের ২১শে জুন। মাধ্যমিক দুই স্তরের টেন্ডার করা হয়। একটিতে এনসিটিবি কাগজ কিনে দেয় সেটি ৩৪০ লট যেটা শিড নামে পরিচিত। সেটার কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হলেও সবচেয়ে বেশি বই ছাপার লট ৩২০ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আর একাদশ শ্রেণির তিনটি বই ছাপার টেন্ডারে কোনো প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়নি। সর্বশেষ সমঝোতা করে বই ছাপার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে এনসিটিবি।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ৩৪০ লটের কাজের জন্য ৭ হাজার টন কাগজ ও ১৩০ টন আর্ট পেপার কিনেছে এনসিটিবি। ৯টি প্রতিষ্ঠান প্রতি টন কাগজের কাজ পেয়েছে গড়ে ৯৯ হাজার টাকায়। প্রাথমিকের প্রাক্কলন ধরা হয় দর গড়ে ৬৪ হাজার করে। যেই টাকায় এনসিটিবি কাগজ কিনতে পারেনি সেই টাকায় মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের কাগজ কিনে বই ছাপার জন্য প্রাক্কলন ঠিক করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। মূল্যায়ন কমিটি বিষয়টিতে সমালোচনা হলেও দুইজনকে সরিয়ে দেয় এনসিটিবির চেয়ারম্যান। তাদের অভিযোগ, গত বছর ডিসেম্বরের ঠিক করা মূল্যের সঙ্গে বর্তমান বাজারের টন প্রতি কাগজের দাম বেড়েছে ৪০-৪৫ হাজার টাকায়। একই সঙ্গে আর্ট পেপার ও পাল্পসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ডলারে দাম বেড়েছে গড়ে ৬-৭ টাকা। এই অবস্থায় গত ডিসেম্বরের প্রাক্কলন দিয়ে এখন কাজ করা সম্ভব না বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।   
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, নতুন সিডিউল অনুযায়ী অক্টোবরে বই দেয়া সম্ভব না। এজন্য এনজন সদস্য প্রাথমিকের টেন্ডারে সময় নষ্ট না করে চলমান টেন্ডারকে ঠিক রেখে সমাধান করার প্রস্তাব দেন। সমাধানের জন্য তিনি পিপিপি’র ৯৮ ধারার ২৫-এ তিনটি ধারা কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেন, প্রাক্কলিত বাজার দরের চেয়ে বর্তমান বাজার দরে হওয়ায়  এক্ষেত্রে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। দুই নম্বর অপশন রি-টেন্ডার আহ্বান করলে আগের দর রেখে কাজ দেয়া সম্ভব না। কারণ বাজারে কাগজের দাম অনেক বেশি। তিন নম্বর অপশন ছিল নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা। এনসিটিবির মূল্যায়ন কমিটির এমন সিদ্ধান্ত আটকে দেয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। তারা মূল্যায়ন কমিটি সদস্য বদল করে তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত আনেন। নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করেন। জানা গেছে, নতুন টেন্ডারের প্রাক্কলনের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে সর্ব্বোচ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। অন্যদিকে মাধ্যমিকে ৩৪০ লটের (এনসিটিবি কাগজ করে বই ছাপায়) টেন্ডার অনুমোদন হলেও ৩২০ লটের প্রক্রিয়া জটিলতা তৈরি হয়েছে। রঙিন বইয়ে চার কালারে ৮০ গ্রাম কাগজের কাজ পুনরায় টেন্ডার দেয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আর বাকি বইয়ে ১০% বেশি পর্যন্ত গ্রহণ করবে এনসিটিবি। তবে এর বেশি কী হবে তা এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি এনসিটিবি। এ ব্যাপারে সদস্য পাঠ্যপুস্তক বলেন, ৩২০ লটের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হবে দ্রত সময়ের মধ্যে। তবে ৩২০ লটের কাগজপত্র যাচাই বাছাই চলছে। তাই এটা নিয়ে এখনই মন্তব্য করার সময় আসেনি।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান মানবজমিনকে বলেন, বই নিয়ে যা তা রীতিমত স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত। এজন্য এনসিটিবি দায়ী থাকবে। একজন ব্যক্তির জন্য পুরো প্রজেক্ট ফেল করতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এনসিটিবি আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না। প্রাথমিক পর্যায়ে বই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। এমনটি হলে আমরা পুরো পাঠ্যবই ছাপা বয়কট করবো। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এনসিটিবি থেকে সব তথ্য বিদেশিদের দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টিতে সরকারের সর্ব্বোচ মহলের দৃষ্টি চান ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান বলেন, মাধ্যমিকের টেন্ডার চলমান আছে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি পুনঃটেন্ডারের মত দিয়েছে। মাধ্যমিকের রঙিন বই ৩২০ লটে টেন্ডার দেয়া হয়েছে। এগুলো রিটেন্ডার হওয়ার সুযোগ নেই। দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অক্টোবরের মধ্যে বই সরবরাহরে টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। তবে রিটেন্ডার হওয়া বই নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status