এক্সক্লুসিভ

পাসপোর্ট জটে সব শেষ হাজারো চট্টগ্রামবাসীর

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

২৩ মে ২০১৮, বুধবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও থানার সমশের পাড়া চাঁদমিয়া সওদাগর বাড়ির বাসিন্দা আমির হোসেন। সোমবার রাতে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তার মৃত মেয়ের সামনে মাথায় হাত চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন তিনি। স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিয়েও পেরে উঠছিলেন না। বলছিলেন, পাসপোর্টে আমার সবশেষ। হঠাৎ কথাটি শুনে সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সবশেষ হয়ে গেছে। একটি পাসপোর্টের জন্য আমার মেয়েকে হারাতে হয়েছে। এই দেশে বেঁচে থেকে কি লাভ। এমন দেশে জন্ম নেওয়াটাই যে আজন্ম পাপ। এই কথা বলেই মাথা চাপড়ান তিনি।  
আমির হোসেনের স্বজন নজরুল ইসলাম জানান, ওর মেয়ে সোহানা নবম শ্রেণিতে পড়ে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সে। চিকিৎসকরা বলেছেন ভারতের মুম্বই হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা করাতে। এতে হাল না   ছেড়ে ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাদ সাধল পাসপোর্ট অফিস।
তিনি বলেন, দুই মাস আগে ১৫ দিনের মধ্যে মেয়ের পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশে আবেদন করেন আমির হোসেন। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় মাস পার হয়ে গেছে। এখনো পাসপোর্ট ডেলিভারি পায়নি।
পাসপোর্ট না পেয়ে আমি ও আমির হোসেন পাঁচলাইশ অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বলছে ঢাকায় নাকি প্রিন্টার মেশিন নষ্ট। তাই পাসপোর্ট ডেলিভারি হয়নি। তবে রমজানের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর এর মধ্যে চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে সোহানা। সোহানাই আমির হোসেনের একমাত্র মেয়ে।  
ক্ষোভ প্রকাশ করে নজরুল ইসলাম বলেন, প্রিন্টার মেশিন এক বা দু’দিন নষ্ট থাকতে পারে। পরে তো ঠিক করিয়ে নিতে পারে। এতদিন কি মেশিন নষ্ট থাকে?
পাসপোর্ট নিয়ে নানা ভোগান্তি ও ক্ষতির কথা জেনে  মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশে গিয়ে দেখা যায়, প্রার্থীদের নানা আর্তি। এমন এক করুণ আর্তির কথা জানালেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মুরাদনগর পৌর এলাকার বাসিন্দা ফতনি বেগম।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে যাওয়ার জন্য আমার মেয়ে ভিসা পেয়ে এক মাসের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করি। এজন্য আমি ৮ হাজার টাকা দিই। কিন্তু গত আড়াই মাসেও আমি পাসপোর্ট পাইনি। এদিকে ভিসায় গত ২০ মের মধ্যে ওমানে যাওয়ার তারিখ ছিল। সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় আমার ভিসার টাকাসহ সব শেষ। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ভিসার টাকার জন্য ধার-কর্জ করেছি। এগুলি আমি কিভাবে দেব।  
শুধু আমির হোসেন বা ফতনি বেগম নন, শত শত মানুষ পাসপোর্ট না পেয়ে আর্তি করছেন পাসপোর্ট কার্যালয়ে। কেউ কেউ রাগতস্বরে গজগজ করে ক্ষোভও ঝাড়ছেন। যাদের সবারই এক কথা, পাসপোর্ট না পেয়ে তাদের সব শেষ।
আর শতশত নয়, পাসপোর্টের জন্য আটকা এমন হাজারো মানুষের কথা জানা গেল খোদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস মনসুরাবাদের উপপরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেনের কাছে। যদিও হাজারো মানুষের আর্তির কোনো ছাপ নেই ওর চোখে-মুখে।
বরং গুরুগম্ভির স্বরে তিনি বলেন, আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় প্রিন্টার মেশিনে কারিগরি ত্রুটির কারণে পাসপোর্ট ডেলিভারিতে জট লেগেছে। এ ত্রুটির কারণে চট্টগ্রামের প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি পাসপোর্ট আটকে গেছে।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রিন্টার মেশিনে ত্রুটির কারণে চট্টগ্রামের ১০ হাজারেরও বেশি গ্রাহকের পাসপোর্ট নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে রোগী কিংবা জরুরি প্রয়োজন থাকা আবেদনগুলো বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তালিকা করে ঢাকায় পাঠিয়ে গ্রাহকদের ডেলিভারি দিয়েছি।
পাসপোর্ট না পেয়ে ভারতের মুম্বই হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার অভাবে সোমবার রাতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত স্কুলছাত্রী সোহানার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই জানা নেই। সম্ভবত রোগের বিষয়টি আবেদনে উল্লেখ করেনি।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশের উপপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ভিসা সহজীকরণ করায় পাসপোর্টের জন্য আবেদনও বেড়েছে। এতে চট্টগ্রামে প্রায় ১১ হাজার পাসপোর্টের জট লেগেছে। তবে বর্তমানে প্রিন্টার মেশিনগুলো সচল হয়েছে। রমজান মাসের মধ্যে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সাধারণ ভিত্তিতে ৩ হাজার ৪৫০ টাকা জমা দিয়ে নির্ধারিত ২১ কর্মদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মূলত ৩০ থেকে ৪৫ দিন এবং জরুরি ভিত্তিতে ৬ হাজার ৯০০ টাকা জমা দিয়ে নির্ধারিত ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ডেলিভারি দেয়ার নিয়ম থাকলেও আবেদনকারীরা ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পায়। সেক্ষেত্রেও অধিক টাকা খরচ করতে হয় পাসপোর্ট প্রার্থীদের।
পাসপোর্ট প্রার্থীদের অভিযোগ, পাসপোর্ট ফরম পূরণ, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া সবকিছু করেন অফিসের বাইরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করা দালালরা। যাদের বিশেষ চিহ্ন থাকা ফরম জমা করা হয় আবেদনকারীদের দিয়ে। ফরমে দালালদের বিশেষ চিহ্ন না থাকলে তা নিয়ে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় আবেদনকারীদের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status