দেশ বিদেশ

এবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ‘অলস’ অর্থ চায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২০ মে ২০১৮, রবিবার, ৯:১৯ পূর্বাহ্ন

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ‘অলস’ অর্থ (বিভিন্ন বন্ডে রাখা স্বল্প সুদের বিনিয়োগ) নিতে চায় দেশের বেসরকারি বাণিজ্যক ব্যাংকগুলো। ‘অলস’ পড়ে থাকা এই অর্থ বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করতে দিলে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করারও চেষ্টা করছে বিএবি।
জানা গেছে, এর সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে সরকারের কাছ থেকে এ পর্যন্ত চার ধরনের সুবিধা নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা ঋণের সুদহার কমাননি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ‘অলস’ পড়ে থাকা অর্থ তাদেরকে দিলে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে তারা দাবি করছে। বিএবি মনে করে, বর্তমানে সরকারি ব্যাংক যে সুদে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়, সেই ঋণই বন্ডের মতো স্বল্প সুদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেসরকারি ব্যাংককে অর্থ দিতে পারে।
বিএবি সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ পড়ে আছে। সেই টাকা বেসরকারি ব্যাংক ব্যবহার করতে পারলে সুদের হার দ্রুত কমে আসবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অর্থ আমরা কীভাবে নেবো, সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে হবে। এজন্য আমরা অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছি।
সূত্র জানায়, সমপ্রতি বিএবি’র নেতারা জরুরি বৈঠক করেছেন। সেখানে ব্যাংকের মালিকরা জানিয়েছেন, আমানতে সুদহার বেশি থাকার কারণে ঋণে সুদহার কমছে না। তহবিল সংকটে পড়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে।
অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তাদের সংগৃহীত আমানতের মাত্র ৫৪ শতাংশ ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। বিধি অনুযায়ী, ১৯শে শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাতে ২৭ শতাংশ আমানত অলস পড়ে আছে। যেগুলো ৬ শতাংশ সুদে সরকারের বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে। এই অলস অর্থ বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ১১ শতাংশের কমে দিচ্ছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
বিএবি’র বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকের অলস অর্থ ৬ শতাংশ সুদে বেসরকারি ব্যাংক যাতে পেতে পারে, সে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। অচিরেই বিষয়টি নিয়ে বিএবি’র নেতারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
সমপ্রতি সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কথা বলে চার ধরনের সুবিধা নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা। বিএবি’র চাহিদা অনুযায়ী সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা; সিআরআর ১ শতাংশ হ্র্রাস; ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬.৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। তারপরও ঋণের সুদহার বাড়ছে এবং তা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এত সুবিধা পাওয়ার পরও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তারল্য সংকটের কারণে তারা ঋণে সুদের হার কমাতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে সুদের হার বেড়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে সুদহার এক অঙ্কে আনতে হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অলস অর্থ অল্প সুদে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি বা বিদেশি সব খাতের ব্যাংকই ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে। মার্চ মাসে ৪৪টি ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়িয়েছে। দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সবক’টিতেই এখন দুই অঙ্কের সুদ গুনছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে শিল্পঋণ পেতে ব্যবসায়ীদের ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে।
সম্প্রতি এনসিসি ব্যাংকের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মো. নূরুন নেয়াজ সেলিম বলেছিন, আমানতের বেশি সুদ থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুদহার একক অঙ্কে নামানো সম্ভব হচ্ছে না। আমানতে সুদ হার কমাতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাতে পড়ে থাকা অলস অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে নিতে চাচ্ছি।
এদিকে বড় বড় উদ্যোক্তাদের বৃহৎ অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে দেশের ব্যাংকিং খাত। এসব বড় উদ্যোক্তারা যথাসময়ে টাকা ফেরত না দেয়ায় সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকি খাতের মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশই দেয়া হয়েছে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ।
এতে বলা হয়েছে, গত বছরের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মূলধন ছিল ২,৯৭৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি বৃহৎ ঋণ দিয়েছে ১৩,৩৭৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ৩৬৫ শতাংশ। একই সময়ে সোনালী ব্যাংক বৃহৎ ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ৫৪৬ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংক দিয়েছে মোট মূলধনের ৫৫৫ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংক ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ১৯৯ শতাংশ। এভাবে ৫৫টি ব্যাংক তাদের ৯০ হাজার ১৩১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে বৃহৎ ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। যা মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশ।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, কৃষক ও ছোট উদ্যোক্তারা যথাসময়ে ঋণের টাকা ফেরত দিলেও প্রভাবশালীরা দিচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৫টি ব্যাংক বড় ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিয়েছে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। যা মোট দেয়া ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, কোনও ব্যাংকের মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নিলেই তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণ ব্যাংক কোনও একক গ্রাহককে ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। এর বেশি ঋণ দিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণার তথ্য বলছে, যথাসময়ে ফেরত না দেয়ায় অধিকাংশ বড় অঙ্কের ঋণই খেলাপি হয়ে পড়ছে। এই খেলাপির ঋণের একটি বড় অংশ অবলোপনও করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে ভালো গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিআইবিএম’র প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বড় ঋণের পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০১০ সালে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা (৫০ কোটি টাকার বেশি) ঋণের মধ্যে বৃহৎ বা বড় ঋণ ছিল ১৮.৮০ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয় ২১.৪৩ শতাংশ, ২০১২ সালে হয় ২২.৩৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে ২৩.৭৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে বড় ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩১. ৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ ভিত্তিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিনজন করে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলেই ঝুঁকিতে পড়বে দেশের ২৫টি ব্যাংক। একইভাবে শীর্ষ ৭ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ঝুঁকিতে পড়বে ২৯টি ব্যাংক এবং শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ৩৫টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status