এক্সক্লুসিভ

দরিদ্র ৮ মেধাবীর গল্প

মো. সাওরাত হোসেন সোহেল চিলমারী (কুড়িগ্রাম) থেকে

১৮ মে ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় আর সংগ্রাম করে তা জয় করা যায় তাই প্রমাণ করলো ৮ অদম্য মেধাবী। কোনো বাঁধাই আটকাতে পারেনি তাদের। দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছে ওরা। দরিদ্রতা কখনও তাদের মেধা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অদম্য ইচ্ছা শক্তি তাদের দুর্লভ সাফল্য এনে দিয়েছে। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়েছে এ অদম্য মেধাবীরা। পারভিন আক্তার, ইসতিয়া আক্তার, আরিফা আক্তার, আইরিন আক্তার, আরিফা খাতুন, জয়নব আক্তার, বিথি খাতুন এবং আইরিন আক্তার এরা সবাই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে চায়। হতে চায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
পারভিন আক্তার
সম্পদ বলতে ৩ শতক জমির ওপর দুটি টিনের চালা। রিকশা বা শ্রম বিক্রি করে একমাত্র আয় পিতা শহিদুল ইসলামের। ২ কন্যা ১ ছেলে নিয়ে তার ৫ জনের সংস্যার। তিন বেলা পেটপুরে খাবার জোগাড় করাই কঠিন। তার ওপর পড়াশুনা যেন পাহাড় ঠেলার সমান। পিতা শহিদুল আর মা মর্জিনা বেগমের রাতে ঘুম হয় না ছোট মেয়ে পারভিনের পড়ালেখা কিভাবে চালাবেন? সে পড়তে চায়। স্বপ্ন দেখে প্রকৌশলী হওয়ার। মেয়ের স্বপ্ন পূরণে প্রধান বাধা অর্থনৈতিক দীনতা। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় থানাহাট বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাড়ি দক্ষিণ উমানন্দ বংশিপাড়া।
ইসতিয়া আক্তার
স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায় ইসতিয়া। দরিদ্রতা এবং পারিবারিক নানা সংকট বিকশিত হওয়ার পথকে সঙ্কুচিত করেছে। তাই তারা স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। বাবার নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। কাজ করলে জোটে না করলে নাই, সবাই তা বোঝে, ধারদেনা, অন্যের সহায়তা নিয়ে ৪ জনের টানাটানির সংসার। নেই বই-খাতা-কলম-পোশাক। ভালো খাবারও নাই; শুধু নাই আর নাই। শত প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভোকেশনাল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। উমানন্দ জঙ্গলতোলা তাদের বসবাস। ইসতিয়ার যদিও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় ইচ্ছা কিন্তু বড় বাধা এখন তার দারিদ্র্য। ভালো ফল নিয়েও এখন চিন্তার সাগরে তার বাবা মা এবং সে নিজে।
আরিফা আক্তার
উপজেলার মুদাফৎথানা সরকার পাড়া এলাকার কাঠমিস্ত্রির প্রথম কন্যা আরিফা আক্তার। সে এবারে থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাবার রোজগারের উপরেই ভরসা। বাবা যা আয় করেন তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে ৫ জনের সংসার। পায়নি ভালো পোশাক জোটেনি ভালো খাবার তার। তবুও থেমে থাকেনি আরিফা, আটকে যায়নি মেধা। তাই তো এবারে শত কষ্টের মধ্যেও জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে দিয়েছে তাক লাগিয়ে। তার ইচ্ছা একজন আদর্শবান শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু বাবা, মা বড় চিন্তায় কিভাবে তার ইচ্ছা করবে তারা পূরণ ?
আইরিন আক্তার
আইরিন আক্তার চলতি এসএসসি পরীক্ষায় থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ভোকেশনাল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাবা একজন মাংস বিক্রেতা, নেই সহায় সম্বল। এরপরও সংসার খরচ, যোগ হয়েছে পড়ালেখার বাড়তি খরচ। মেয়ের ভালো ফলাফলেও হয়ে পড়েছে হতাশ। মেয়ের ইচ্ছা লেখাপড়া করার, কিন্তু বাবার ইচ্ছা আছে; সাহস নাই। শত অনিশ্চয়তার মাঝেও আইরিন আক্তার স্বপ্ন দেখে পড়াশুনা করে একজন ভালো মানুষ হওয়ার। স্বপ্ন দেখে একজন আইনজীবী হওয়ার। তার বাড়ি বহরের ভিটা। বাবার নাম আমিনুল ইসলাম।
আরিফা খাতুন
আরিফা খাতুনের বাবা একজন ফুটপাথের চালের দোকানদার। পুঁজি নেই, তাই ব্যবসাও ভালো নেই। অভাব কিন্তু পিছু হঠে নাই। শত অভাবের মাঝেও আরিফাকে দমে রাখতে পারেনি দারিদ্র্য। পিছু টান থাকলেও সব বাধা পেরিয়ে সে এবারে থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে একজন প্রকৌশলী হতে চায়। তার বাড়ি মাছাবান্দা ফকিরপাড়া। বাবা আবুল আলী বলেন অভাবের সংসার। তার উপর লেখা পড়ার খরচ বড় মুশকিলে তার পিতা। কিভাবে মেয়েকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবেন এই তার টিন্তা।
জয়নব আক্তার
উপজেলা মণ্ডলপাড়া এলাকার দিনমজুর জয়নুল আবেদীনের মেয়ে জয়নব আক্তার। জয়নুল আবেদীন শারীরিক কারণে আর তেমন কাজও করতে পারে না ফলে দেখা দিয়েছে অভাব অনটন। জয়নবের পড়াশুনার বড় বাধা অভাব আর দারিদ্র্য। নাই কোনো জমাজমি, শুধু আছে ৪ শতকের উপর বাড়িভিটাটুকু। ভালো ফল করলেও নেই কোনো আমেজ। কি হবে তার ভবিষ্যৎ এটাই এখন তার প্রশ্ন ?
আইরিন আক্তার
সংসারে অভাব অনটন লেগে থাকে দারুণ কষ্ট, তাই তো আইরিনকে থাকতে হয় নানার বাড়িতে। বাবা মোহাম্মদ আলী কাজ করলে ভাত জোটে, না করলে নাই। অভাব আর অনটন যেন নিত্য দিনের সঙ্গী, তাই উপজেলার শান্তিনগরে নানা দলু মিস্ত্রীর বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করতে হয় তাকে। সে এবারে এসএসসি (ভোকেশনাল) থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। আইরিন ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। চায় জনগণের সেবা করতে। দাঁড়াতে চায় গরিব দুঃখীদের পাশে।
বিথি খাতুন
উপজেলার দক্ষিণ খড়খড়িয়া জুম্মাপাড়া এলাকার বাবলু মিয়ার মেয়ে বিথি। কখনো দেখেনি সুখের বাতি। পেয়েছে শুধু নেই শব্দটি। বাবা সামান্য একজন চটি দোকানদার। চটি (রাস্তার ধারে মাদুর বিছিয়ে দোকান) জুতা বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই ৪ জনের সংসার চালাতে হয়। বাবার সামান্য আয় নিয়ে সংসার চালানোই বড় কষ্টকর। পড়াশুনা চালাবে কিভাবে? তাই এখন ভালো ফল অর্জন করেও চোখে জল বিথির। মা হাসিনা চায় মেয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করুক, কিন্তু সাধ আছে সাধ্য যে নাই, তাই তো চোখে জল ফেলে মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়। বিথি থানাহাট বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রমাণ করেছে অভাব বা দারিদ্র্য তাকে আটকাতে পারেনি। সে ভবিষ্যতে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে জীবন গড়তে চায়, দেশের মানুষের সেবা করতে চায়।


   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status