এক্সক্লুসিভ

তারুণ্যের সংকট

কেন মিলছে না চাকরি?

উৎপল রায়

১০ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষকরা বলছেন- সরকারি চাকরিতে পদের বিপরীতে তীব্র প্রতিযোগিতা, কোটার প্রতিবন্ধকতা, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর বহাল রাখা, নিয়মিত শূন্য পদ পূরণ না হওয়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুষ ও তদবির বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বেকারদের কাছে সরকারি চাকরি সবসময়ই ‘সোনার হরিণ’। অন্যদিকে বেসরকারিখাতে কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থীর চাহিদা বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে শিক্ষার্থী স্বল্প। যে কারণে বেসরকারিখাতে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে সাধারণ ও প্রচলিত শিক্ষার্থীদের জন্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি চাকরির বাইরে বড় ভরসা বেসরকারিখাত। বর্তমানে বিকাশমান অর্থনীতি ও শিল্পখাতে কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন লোকের চাহিদা বেশি। এক্ষেত্রে সাধারণ ও প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাহিদা কম থাকায় তাদের বিশাল একটি অংশ বেসরকারিখাতে চাকরিতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে, বেকারত্বের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। কৃষি, শিল্পে লেগেছে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। গার্মেন্ট, ওষুধ শিল্পসহ বেসরকারি নানা ক্ষেত্রে লোকবলের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে যে পরিমাণ কারিগরি ও প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন লোকবল প্রয়োজন সেই অনুপাতের শিক্ষার্থী দেশে নেই। সঙ্গত কারণেই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের দিয়ে সে অভাব পূরণ করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে লোক এনে সেই অভাব পূরণ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম সেখানে বেকার সমস্যা থাকবেই। বেকারত্বের জন্য কর্মসংস্থান যেমন একটি সমস্যা, তেমনি মানসম্মত কর্মস্থানের অভাবও আরেকটি সমস্যা। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির কৌশলে যেভাবে আমরা এগুচ্ছি, সেখানে কর্মসংস্থান কম তৈরি হচ্ছে। আর বেকাররা যে ধরনের কর্মসংস্থান পেতে চায়, সে ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারি চাকরি এক ধরনের নিশ্চয়তার বিষয় বলে এর প্রতি আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। যদি ব্যক্তি ও বেসরকারিখাতে অনেক কর্মসংস্থান থাকতো তাহলে সরকারি চাকরির প্রতি এত নজর থাকতো না। আর সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার জায়গায় দুর্বলতা আছে। দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ও আছে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা শুনি জনবল সংকট। দেখা যাচ্ছে জেলায় জেলায় আড়াইশ বেডের হাসপাতাল হচ্ছে, কিন্তু জনবল আছে ৫০ বেডের। সরকারি চাকরিতে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এগুলো সচল হচ্ছে না। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চাকরি না পাওয়ার মূল কারণ হলো কর্মসংস্থানের সংকট। এই যে কোটা সংস্কার আন্দোলন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর আন্দোলন- এগুলো চাকরির সংকটের কারণেই। তিনি বলেন, একটা চমকপ্রদ তথ্য হলো, বাংলাদেশে আশপাশের দেশ থেকে কিছু সংখ্যক লোক এখানকার কর্মসংস্থানের সুযোগ নিচ্ছে। তার মানে আমাদের তরুণ তরুণীদের যে শিক্ষা আমরা দিচ্ছি এই প্রতিযোগিতার বাজারে সেটা নেয়া হচ্ছে না। আর অন্যরা আশপাশ থেকে এসে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমরা সচেতন না।  
কেন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে এমন প্রশ্নে শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থাও ভালো নয়। এ কারণেই বেকার ও উচ্চশিক্ষিত বেকার বাড়ছে। তিনি বলেন, নৈতিক আস্থাহীনতা ও জাতীয় লক্ষ্যহীনতা- এগুলো যুক্ত হয়ে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, বেকারত্বের সমস্যা প্রত্যেক জাতির মধ্যেই আছে। সরকার সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করে চিন্তা করে যতটুকু পারা যায় সমাধান করে। বেকার সমস্যার সমাধানের নানা উপায়ও আছে। তবে, এ নিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।  আমাদের আরো বেশি কর্মমুখী, কারিগরি ও পেশামুখী শিক্ষা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের শিক্ষিতরা যে ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত এটি সবসময় আমাদের বর্তমান বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। সেজন্যই কেউ কেউ চাকরি পায় না। তবে, এখানে চাকরিদাতারাও সমস্যা সৃষ্টি করে। তারা অভিজ্ঞ, দক্ষ লোক চায়। কিন্তু দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক তো সবসময় পাওয়া যাবে না। এটিতো চাকরি ও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমেই হবে। এটি পৃথিবীর সব দেশেই হয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমাদের যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ম্যানুফেকচারিং এগুলো শ্রম নিবির নয়। এগুলো শ্রম নিবির থাকা দরকার। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বেকারত্ব সমস্যা নিরসনে আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি আরো বেশি নজর দেয়া উচিত।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এতদিন পর্যন্ত যে খাতগুলোতে মূল কর্মসংস্থানের চালিকাশক্তি বলা হতো সেই খাতগুলো ধীরে ধীরে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য আরো বেশি মেকানাইজড ও মেশিনকেন্দ্রিক হচ্ছে। সে কারণে যে মাত্রায় আগে কর্মসংস্থান তৈরি হতো, সেই মাত্রায় এখন কর্মসংস্থান কম। তিনি বলেন, দেশে জেনারেল ডিগ্রিধারী পেশাদারদের চাহিদা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। যেহেতু শিল্পখাতের উন্নয়ন হচ্ছে আগামীতে নতুন নতুন শিল্পখাত আসবে। তাই আগামীতে জেনারেল ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটদের কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসবে। সেক্ষেত্রে আরো বেশি টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদার লোক দরকার। খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, শিক্ষিত বেকারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দুটো বিপরীতমুখী চিত্র রয়েছে। একদিকে প্রতিবছর সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে প্রচুর সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে, তারা চাকরির জন্য আবেদনও করছে। অন্যদিকে দেখা যায় বাংলাদেশে বিদেশ থেকে এসে প্রচুর পেশাদার লোক বেসরকারি বিভিন্ন খাতে কাজ করছে এবং দেশ থেকে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। এখন যেটি বলার বিষয় সেটি হচ্ছে- দেশে যারা গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে এবং তারা যে শিক্ষা পাচ্ছে তাতে তারা যথেষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন নন। তাদের সেই দক্ষতার ঘাটতির জন্যই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি এবং পেশাদারদের নিয়োজন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা কাঠামোতে পরিবর্তন দরকার। আরো বেশি কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষা দরকার। আমাদের ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষাকে আরো উন্নত করতে হবে।
গিভেন্সি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল মানবজমিনকে বলেন, বাবা মায়েরা কত কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছে। কিন্তু তারা চাকরি পাচ্ছে না। বেকার থাকছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে কর্মীরা এসে আমাদের দেশে কাজ করে আমাদের দেশের টাকা তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চাকরি না পাওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সরকারি চাকরিতে কম পদের বিপরীতে প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। আর বেসরকারি ও শিল্পখাতে যে পরিমাণ কারিগরি ও মেধাসম্পন্ন প্রার্থীর প্রয়োজন হয়, সেই মানের প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা আরো প্রসারের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক ও যুগপোযোগী করতে হবে এমন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের শিক্ষার্থীরা অনার্স, মাস্টার্স পাস করছে। কিন্তু চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অনেকেরই মৌলিক, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি জ্ঞান খুবই সীমিত। অনেকেই ভালো ইংরেজি জানে না। মনে হয় যেনতেনভাবে একটা ডিগ্রি নিয়ে একটা চাকরি খোঁজাই তাদের পড়াশোনার উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে করে চাকরির বাজারে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারাকাত বলেন, অনেক ক্ষেত্রে পদ খালি আছে।   ব্যাংক ও কর্পোরেট সেক্টরে খালিপদগুলো পূরণ করা হচ্ছে না। সরকারি চাকরিতেও বহু পদ খালি রয়েছে। কিন্তু পূরণ হচ্ছে না। এই পদগুলো পূরণ করলেও কিছু সমাধান হয়। আর সর্বোপরি দেশে ব্যাপকহারে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ দরকার। না হলে বেকারত্বের এই সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিই শুধু চাকরি নয়। দেশে উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট ধারা তৈরি হচ্ছে। এখন অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। এখানে কারিগরি শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রয়োজন। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই, সামনের ১০/২০ বছরে কি ধরনের শিক্ষিত মানুষ আমাদের দরকার। এজন্য একটি কমিশন গঠন করা উচিত। প্রচলিত যে  শিক্ষা ব্যবস্থা এর সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কতটুকু অসামঞ্জস্যতা আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। ড. আবুল বারাকাত বলেন, ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড়মাপের পরিবর্তন আনতে হবে। তবে, সেই পরিবর্তনটা কি হবে সেটি এককথায় বলে দেয়া সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা সামনে রেখে এটি করা দরকার। এজন্য একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা দরকার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status