শেষের পাতা

নি র্বা চ নী হা ল চা ল (সিরাজগঞ্জ-৪)

বড় দু’দলেই কোন্দল

ইসরাইল হোসেন বাবু, সিরাজগঞ্জ থেকে

২৭ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫১ পূর্বাহ্ন

সড়ক ও রেল যোগাযোগ সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ-৪ সংসদীয় আসনটি উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। শস্য এবং ব্যবসায়িকভাবে সমৃদ্ধ এই আসনটি নিয়ে সব রাজনৈতিক  দলেরই রয়েছে বাড়তি নজর। এ আসনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির মধ্যে সবসময় হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী যুদ্ধ হয়। যদিও উভয় দলই কোন্দলে বিপর্যস্ত। তবে উভয় দলের নেতাকর্মীরা আশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সবাই মনোনীত প্রার্থীকে নিয়ে একযোগে মাঠে নামবে। নানা কারণে চাপে থাকা জামায়াত তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাচ্ছন্দ্যে চালাতে না পারলেও এই অঞ্চলে রয়েছে তাদের বড় ভোট ব্যাংক। ভেতরে ভেতরে তারাও কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে স্থানীয় নির্বাচনগুলোর মতো জামায়াতও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

১৯৯১ এবং ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী এম. আকবর আলী এই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অপরদিকে, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে থাকে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং এলাকার উন্নয়নে তার ভূমিকায় এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে ওঠে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আব্দুল লতিফ মির্জা প্রয়াত হলে এই আসনে নৌকা নিয়ে বিজয়ী হন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা গাজী শফিকুল ইসলাম (শফি)। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম এই আসনের সংসদ সদস্য মনোনীত হন।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসনের সব দলেরই আগ্রহী সম্ভাব্য প্রার্থীরা যার যার অবস্থানে থেকে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরাই রয়েছেন এগিয়ে। এছাড়া প্রচারণার ক্ষেত্রে ফেসবুকের ব্যবহার এবারের নির্বাচনী প্রচারে ভিন্নতা এনেছে। তাদের নানা কর্মতৎপরতা জনসংযোগ আর উন্নয়নের চিত্রসহ বিবরণ শোভা পাচ্ছে তাদের নিজ নিজ নামের ফেসবুক পেজে।

আওয়ামী লীগ: ২০১৪ সালের নির্বাচনে তানভীর ইমাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনের সময় দলীয় সব নেতাকর্মী দলের সিদ্ধান্ত মেনে তানভীরের পাশে থেকে কাজ করেছেন। এ আসনের আওয়ামী লীগের দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচি পৃথকভাবেই পরিচালিত হয়। বর্তমান এমপি তানভীর ইমাম ও সাবেক এমপি গাজী শফিকুল ইসলামের দ্বন্দ্বেই শুধু দলটি বিভক্ত নয়, সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জার মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তির দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণও এ আসনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় পার হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে চলা নানা নাটকীয়তার অবসান এখনো হয়নি।  এখনো সম্মেলন করতে পারেনি দলটি। চলমান এ বিভক্তির দ্বন্দ্বে জেলা পর্যায় থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলে চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  পরিচালনায় বিভিন্ন সময়ে বাকবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটেছে এখানে। জামায়াত-বিএনপির আন্দোলনের সময় এ অঞ্চলে বর্তমান এমপি কার্যকরি ভূমিকা রেখেছেন।

নবীন নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে দলের অঙ্গসংগঠনের কমিটি ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী নির্ধারণের মধ্যদিয়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করেছেন। তবে অনেক প্রবীণ নেতার মতে, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের গুণাবলীর চাইতে ব্যক্তি পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যদিও উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনের আওয়ামী লীগের ঘরে জয় আনার পেছনে তানভীর ইমামের শক্ত অবস্থান রয়েছে। তানভীর ইমাম এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে মনোনয়ন প্রত্যাশায় নেতাকর্মীদের নিয়ে সরকারের নানা উন্নয়নের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তানভীর ইমাম জানান, উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরে এটি স্থগিত রাখা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আবারো নৌকার হাল ধরে তিনি এ অঞ্চলের মানুষের পাশে থেকে কাজ করার কথা জানান। এরই মধ্যে সভা-সমাবেশ করে তিনি তার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম শফি ২০০৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। তিনি এমপি থাকাকালে এলাকার উন্নয়নের মধ্যদিয়ে দলে ও সাধারণ ভোটারদের কাছে সু-পরিচিত। দলের একটি অংশকে নিয়ে তিনি এরই মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। দলের নানা জাতীয় ও সাংগঠনিক কাজও তিনি পৃথকভাবে চালিয়ে আসছেন। তিনি জানান, উল্লাপাড়ার রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় শ্রম দিয়ে এসেছি। দলের নানা প্রতিকূলতায় দলের ও নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছি। দলের বিভক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্তই আমার শেষ কথা।

অপরদিকে, সাবেক এমপি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জার মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তিও এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনে তার বাবার বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা থাকার কারণে আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেলে ভোটারদের মাঝে এর প্রভাব পড়বে বলে অনেকের ধারণা। তিনি জানান, বাবার মৃত্যুর পর থেকে উল্লাপাড়ার রাজনীতিতে বিভেদ সৃষ্টি হয়, যা দলের জন্য ও আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। তিনিও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে দল তাকে মনোনীত করলে তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি জানান, এলাকায় তার বাবার জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রয়েছে বড় ভোটব্যাংক; যা আগামী নির্বাচনে তার জয়ে সহায়ক হবে। দলীয় ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানেও তার উপস্থিতি এখন বেড়েছে।

বিএনপি: বিগত সময়ে বিএনপির রাজপথে নানা কর্মসূচি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে কার্যত ভূমিকা না রাখলেও এ আসনে ২০ দলীয় জোটের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। দলের নানা কর্মসূচিতে এখানে দলটি তাদের কার্যক্রমে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থা জানান দেয়। বিগত দিনের আন্দোলনের কারণে এ আসনের বিএনপির নেতৃস্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রয়েছে ডজন ডজন মামলা। এ আসনে বিএনপির ভিত শক্ত হওয়ার পেছনে জামায়াতের সহযোগিতা রয়েছে। সাবেক এমপি এম আকবর আলী ১৯৯১ ও ২০০১ সালে নির্বাচিত হন। সে সময় উল্লাপাড়া উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করেন তার অনুসারীরা। বিশেষ করে সে সময়ে এই উপজেলার রাস্তাঘাটের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের  উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো।

যে কারণে জেলার শিক্ষা নগরী হিসাবে খ্যাতি পেয়েছে উল্লাপাড়া উপজেলা। বর্তমানে এম. আকবর আলীর উল্লাপাড়ায় অবস্থান কম হলেও তার অনুসারী নেতাকর্মীরা জানান, এই নেতার নির্দেশেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এম. আকবর আলী জানান, উল্লাপাড়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললেই আমার জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলবে। তিনি বলেন, এবারে তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয়ী হবেন। তবে উপজেলা বিএনপির  বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির নেতারা জানান, এম. আকবর আলী বিগত উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এলাকায় ছিলেন না। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পৃক্তা কম। বিগত ২০০৮ সলের নির্বাচনে ধানের শীর্ষ প্রতীক নিয়ে জামানত হারিয়ে ছিলেন।  

এদিকে, বর্তমান উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কাজী কামাল এবারে এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি জানান, দীর্ঘদিন দলের সব কার্যক্রমে পাশে থেকে দলকে শক্তিশালী করে আসছি। মামলা, হামলা ও নেতাকর্মীদের পাশে থেকে কাজ করে আসছি। এরই মধ্যে দলকে নির্বাচনমুখী করতে ও নিজের প্রচারণার মধ্যদিয়ে তৃণমূলের কর্মীদের একত্রিত করেছি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দলের দুঃসময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে দেখা যায়নি সাবেক এমপি এম. আকবর আলীকে। এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকেই আসবেন। আগামী নির্বাচনে দল তাকে মনোনয়ন দিলে তিনিও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।  

এছাড়াও এই আসনে বিএনপি থেকে অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী হচ্ছেন অ্যাডভোকেট সিমকী ইমাম খান। তিনি ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে এলাকায় আসা-যাওয়া শুরু করেছেন। তিনি ঢাকায় আইন পেশায় যুক্ত এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষের একজন আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ২০১৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চলাকালে সরকারদলীয় সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিলেন। দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় মনোনয়ন দৌড়ে তিনি এগিয়ে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন।

জামায়াত: এ আসনে জামায়াতের রয়েছে বড় ভোটব্যাংক। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমও বেশ শক্ত। তাছাড়া জামায়াত ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলামের বাড়ি এই উপজেলায় হওয়ায় তিনিও একজন শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দেখা দিতে পারেন। যদি তিনি প্রার্থী হন তবে তা বিএনপির ভোটের ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলতে পারে। ২০০৮ সালের ফলাফলে বিএনপিকে পেছনে ফেলে জামায়াত এই আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল।  

আগামীকাল : মাদারীপুর-১
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status