শেষের পাতা

কবি বেলাল চৌধুরী আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার

২৫ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

একুশে পদকে ভূষিত ষাটের দশকের কবি বেলাল চৌধুরী আর নেই। রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুর ১২টার দিকে   শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। কিডনি জটিলতা, রক্তশূন্যতা ও থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে গত চার মাস ধরে ওই হাসপাতালে প্রফেসর ডা. ফিরোজ আহমেদ কোরেশীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল তার। গত ১৯শে এপ্রিল রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। পরদিন তাকে নেয়া হয় লাইফসাপোর্টে। সব আশা নিভে যাওয়ার পর মঙ্গলবার বেলা ১২টা ১ মিনিটে চিকিৎসকরা লাইফসাপোর্ট খুলে নেন। কবির মৃত্যুর সংবাদে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা ছুটে যান হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে প্রথমে কবির মরদেহ নেয়া হয় তার পল্টনের বাসায়। সেখানে গোসল শেষে মরদেহ রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমঘরে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস গণমাধ্যমকে জানান, আজ সকাল সাড়ে ১০টায় কবির মরদেহ বাংলা একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে কবির কফিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে তাকে তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর শর্শদিতে দাফন করা হবে। একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, ‘কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার লেখা আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। পৃথক শোকবার্তায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘কবি বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশ একজন জনপ্রিয় কবিকে হারালো। তার মৃত্যু সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার প্রয়াত কবির আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস।
একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালে ১২ই নভেম্বর ফেনীর শর্শদিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার পিতা রফিক উদ্দিন আহমাদ চৌধুরী ও মা মুনীর আখতার খাতুন চৌধুরানী। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছাত্র অবস্থায় তিনি বামধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাগারেও যান। ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েক বছর কলকাতায় বসবাসের সময় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’-এ চাকরি করেন। পরে পল্লীবার্তা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত হন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রকাশিত ‘ভারত-বিচিত্রা’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। রূপালী গ্রুপের ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ’ পত্রিকাটিও তিনি সম্পাদনা করেন।  বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। প্রগতিশীল সাংস্কৃৃতিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন সন্তানের পিতা। তার মেয়ে সাফিয়া আক্তার চৌধুরী মৌরী ও ছেলে আবদুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী এবং আবদুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী পাবলো স্ব-স্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত।
কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেলাল চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। তার কাব্যগ্রন্থ হলো: ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থিরজীবন ও নিসর্গ’, ‘স্বপ্নবন্দী’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুক’ ‘যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে’ ও ‘বত্রিশ নম্বর’। তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘তেনার রঙ চন্দ্রশিলা’,  ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’, ‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন- ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’। তার সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’ ও ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’। মৌলিক লেখার পাশাপাশি তিনি অনুবাদ করেছেন হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবলো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্ট্রাবিও পাসের মতো বিশ্ববিখ্যাত কবিদের লেখা। ‘বল্লাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’ ও ‘সব্‌ক্তগীন’ ছদ্মনামেও লিখেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। এছাড়া নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন জীবনে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status