এক্সক্লুসিভ

গার্মেন্ট শিল্পে এখনো শ্রমিকদের কণ্ঠরোধ

মানবজমিন ডেস্ক

২৫ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:০২ পূর্বাহ্ন

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অগ্নিনিরাপত্তার উদ্যোগ শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে। গার্মেন্ট শিল্পে এখনো শ্রমিক ইউনিয়নের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এখনো বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে এ শিল্পে মজুরি সর্বনিম্ন্ন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি স্মরণ করে এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে লন্ডনের প্রভাবশালী দ্য গার্ডিয়ান। ঢাকা থেকে মাইকেল সাফি ও নিউ ইয়র্ক থেকে ডোমিনিক রুশি এ নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন। তারা লিখেছেন, ৯০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ধসে পড়ে রানা প্লাজা। এতে নিহত হন কমপক্ষে ১১৩৪ জন। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো একে শিল্পখাতে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে। এ ঘটনার পর বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্রান্ড ও খুচরা ক্রেতারা বাধ্য হয় অবস্থার পরিবর্তনে। তবে রানা প্লাজা থেকে কোন কোন কোম্পানি পোশাক তৈরি করতো তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিল প্রাইমার্ক, মাতালান ও অন্যরা। প্রায় ২৫০টি কোম্পানি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পরিবর্তনে দুটি উদ্যোগে স্বাক্ষর করে। এর একটি হলো ‘অ্যাকোর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং
 সেফটি ইন বাংলাদেশ’। অন্যটি ‘এলায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’। বাংলাদেশের ২৩০০ গার্মেন্ট শিল্প থেকে পোশাক সরবরাহ নেয় পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো। এসব কারখানায় নাটকীয়ভাবে নিরাপত্তার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে নেয়া হয় এ উদ্যোগ। দুটি উদ্যোগই এ বছর তাদের মেয়াদ পূরণ করছে। অ্যাকোর্ড ও এলায়েন্স হাতেগোনা কিছু বিরোধের নিষ্পত্তি করেছে। অ্যাকোর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েইস বলেন, আমার তো মনে হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে তৈরি পোশাক খাত রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ হলো সবচেয়ে নিরাপদ। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো যেসব কারখানা থেকে পোশাক সরবরাহ নেয় না এমন কারখানার সংখ্যা কমপক্ষে ২০০০। এসব কারখানার শ্রমিকদের অগ্রগতি সামান্যই হয়েছে। এমনকি এসব কারখানায় বাংলাদেশ সরকার অনুসন্ধান বা ইন্সপেকশন করেছে বা মোটেও করে নাই। এখনো এ শিল্পের শ্রমিকদের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রাখেন, এই যে অগ্রগতি তা কতটা টেকসই? যখন অ্যাকোর্ড ও এলায়েন্সের কাজ শেষ হয়ে যাবে তখন কি হবে? পশ্চিমা ক্রেতারা যখন সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছিলেন তখন হাজার হাজার কারখানা মালিক অগ্নিকাণ্ডের ফলে জরুরি নির্গমন পথ, স্প্রিংকলার সিস্টেম, বৈদ্যুুতিক ব্যবস্থা আধুনিকায়ন, অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ করেন।  শ্রমিক অধিকার বিষয়ক গ্রুপ ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভা বলেন, এখন খুব কম গার্মেন্ট কারখানাই আছে যাকে মৃত্যু ফাঁদ বলা যাবে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আগে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে অথবা ভবন ধসে প্রায় ৭১ জন করে শ্রমিক মারা যেতেন। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন সেন্টারের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সংখ্যা এখন কমে বছরে ১৭-তে এসেছে। ব্রান্ডগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক জেমস মরিয়ার্টি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কারখানাগুলোতে যে উন্নয়নের জন্য ৬০ বছর সময় লাগতো, বাংলাদেশ কয়েক বছরেই সে উন্নতি সাধন করেছে। তবে অ্যাকোর্ডের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনো বাংলাদেশের অনেক পোশাক শিল্প কারখানায় নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। এটি উদ্বেগজনক। এ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, অ্যাকোর্ড ও অ্যালায়েন্স যেসব কারখানার পোশাক গ্রহণ করে, তা দেশের মোট পোশাক কারখানার অর্ধেক।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেড় হাজারেরও বেশি তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হয়েছে। এই কারখানাগুলো মূলত রাশিয়া ও তুরস্কে পোশাক রপ্তানি করে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুয়ায়ী, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ১৫ শতাংশেরও কম কারখানা নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের লরা গুতারেজ বলেন, কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে উন্নতি হয়েছে, তা আসলে ‘ব্ল্যাক হোলের’ মতো।

একদিকে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে। শ্রমিকদের নতুন সংগঠন গড়ে ওঠার প্রবণতা কমে এসেছে। অন্যদিকে, পোশাক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনের সংগঠক মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের এক পোশাক শ্রমিক নেতার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে পুলিশ। তাকে ৬০ দিন জেলে আটকে রাখা হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই আন্দোলনের সময় পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেয় পুলিশ। আন্দোলনকারীদের নেতা মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। তাকে বলা হয়, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মর্তারা তার সঙ্গে আলোচনা করবেন। কিন্তু থানায় পৌঁছানোর পর হাত-পা বেঁধে তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। ওইদিন রাতে তাকে একটি বনভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাঁধন খুলে দিয়ে দৌড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ইব্রাহিম দৌড়াতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ইব্রাহিমকে জেলে আটকে রাখা হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সন্দেহভাজন অপরাধী পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে।

শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে বারবার সতর্ক করেছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)। সংগঠনটির এশিয়া অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তুমো পাউতিয়ানেন বলেন, আমাদের অভিমত হলো- যেখানে শ্রমিকদের প্রতিবাদের অধিকার স্বীকৃত না, সেখানে শ্রমিকদের নিরাপত্তাও নেই।
শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে দুইটি বিখ্যাত ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জারা ও এইচ অ্যান্ড এম ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি বাণিজ্যিক সম্মেলন বর্জন করে। এর পর ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা কয়েকটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দুটি মামলা এখনো চলছে।

তবে কারখানা মালিকরা বিদেশি ক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। তারা বলেছে, বিদেশি ক্রেতারা একদিকে কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার শর্ত দেয়, অন্যদিকে পোশাকের দাম কমানোর অনুরোধ করে। দেশের সবচেয়ে বড় পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদি গ্রুপের রুবানা হক বলেন, ক্রেতারা আমাদের কাছে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু এসব মজুরি কোথা থেকে আসে? কে শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি দেবে?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status