এক্সক্লুসিভ

মাদকের মরণছোবল

মাদকসেবী শিশু-কিশোর ৪ লাখ

রুদ্র মিজান

২১ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

ঢাকার পথে-ফুটপাথে, পরিত্যক্ত স্থানে নেশা করে শিশু-কিশোররা। মূলত ড্যান্ডি নেশা। এটা পুরনো কথা। সাম্প্রতিক অবস্থা আরো ভয়াবহ। যোগ হয়েছে মরণ নেশা ইয়াবা। চার লাখেরও বেশি শিশু মাদকাসক্ত। শিশুদের বিপথগামী করতে সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ী চক্র। টার্গেট শিশুদের মাদকাসক্ত করে এই মাদক বাণিজ্যে জড়ানো। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। প্রথমে মাদকাসক্ত করা হচ্ছে কৌশলে। তারপর মাদকাসক্ত শিশু-কিশোররা ছাড়ছে পরিবার। মা-বাবা ছেড়ে তারা পা দিচ্ছে অন্ধকার জগতে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবাহীন এতিম-পথশিশুদের জড়ানো হচ্ছে বাণিজ্যে। মাদক ব্যবসায়ীদের আস্তানা থেকে শিশু উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। মাদক ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হচ্ছে শিশু মাদক ব্যবসায়ীরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে মাদকাসক্ত চার লাখেরও বেশি শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশ পথশিশু। তারা মূলত ড্যান্ডির নেশা করে। এছাড়াও সম্প্রতি ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের একটা অংশ।
যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, তেজগাঁও, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকায় শিশু-কিশোরদের প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির কাজে ব্যবহার করতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী চক্র তাদের সুবিধার্থে এই শিশুদের মাদক বিক্রির কাজে ব্যবহার করছে। মিরপুর-১১ এর এডিসি ক্যাম্প এলাকায় সিটি করপোরেশনের একটি নির্মাণাধীন মার্কেটের সামনে বেশিরভাগ সময় কয়েক শিশুকে অবস্থান করতে দেখা যায়। দিনভর তারা ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। এরমধ্যেই বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে কথা বলেন। মানিব্যাগ বের করে টাকা দেন। শিশুরা এগিয়ে দেয় পলিথিনের ভাঁজ করা ব্যাগ। তারপর দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে মাদক ক্রেতারা। ওই শিশুদের একজনের নাম শান্ত। ১৫ বছর বয়সের ওই কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ দুই বছর ধরে এই এলাকায় থাকে। তাকে আশ্রয় দিয়েছে বাবর নামে এক ব্যক্তি। বাবর তাকে তিনবেলা খেতে দেয়, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লেখাপড়া করে না শান্ত। তার ভাষায়, লেখাপড়া করি না। কোনো কাজও করি না। খাই আর ঘুমাই।
তার মা-বাবা সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। জানা গেছে, মিরপুর-১২ এলাকার বাসিন্দা এক দরিদ্র দম্পতির সন্তান শান্ত। আশেপাশের ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতে গিয়েই ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়। তার প্রতি নজর পড়ে ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ী, একাধিক মামলার আসামি ফারদিন বাবরের। বাবর তাকে ফ্রি ইয়াবা সেবন করতে দেয়। এভাবেই আসক্ত করে তাকে। ১০টি ইয়াবা বিক্রি করে একটি ফ্রি এমন চুক্তিতে তাকে দিয়ে ইয়াবা বিক্রি করানোও শুরু করে বাবর। শান্তর মতোই ১৬ বছর বয়সী রুবেলসহ অর্ধশত শিশুকে দিয়ে ওই এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে চক্র। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান হলেও বাবর থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মাদক বিক্রির টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে গত ৩১শে মার্চ রাতে নির্মাণাধীন ছয়তলা মার্কেটে হত্যা করা হয় রুবেল মিয়া নামে আরেক কিশোরকে। পুলিশ জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে পরিত্যক্ত এই ছয়তলা ভবনের ভেতরে চারটি খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হচ্ছে, নওশাদ ওরফে কানা নওশা, সোহেল, শিমুল ও সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে রুবেল মিয়া।
পল্লবী এলাকায় শিশু-কিশোরদের দিয়ে মাদক ব্যবসা করার অভিযোগ রয়েছে সেলিনা নামে এক নারীর বিরুদ্ধে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিজের বাসায় রেখে খুচরা মাদক বিক্রি করায় এই নারী। প্রায় সময়ই ১০-১২ শিশু-কিশোরকে দেখা যায় তার বাসায়। তাদের মধ্যে একজন ১৪ বছর বয়সী আল আমিন। গত ৮ই মার্চ সেলিনার বাসা থেকে আল আমিনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। আল আমিনের মা রানু আক্তার জানান, তার ছেলেকে মাদকাসক্ত করে নিজের বাসায় রাখতো সেলিনা। বাসায় রেখে তাকে দিয়ে মাদক বিক্রি করাতো। কোনোভাবেই ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না তিনি। গত ২রা মার্চ ছেলেকে আনতে গেলে এ নিয়ে রানু আক্তারকে হুমকি-ধমকি দেয় সেলিনা। পরদিন পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন রানু। ৮ই মার্চ রাত ১২টায় অভিযান চালিয়ে আল আমিনকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে বর্তমানে একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে সেলিনা দাবি করেছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিজের কাছে রেখে লালনপালন করে সে।
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, তরুণদের পাশাপাশি পলিথিনে করে ক্রেতাদের কাছে মরণনেশা ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে শিশু-কিশোররা। ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন বাচ্চুর পরিবারের ছোট-বড় সবাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। তার ভাতিজি কিশোলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর কাছ থেকে অর্ধশত ইয়াবা উদ্ধার করার ঘটনা ঘটেছে। মূলত ক্রেতার কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার জন্য মাদক ব্যবসায় শিশুদের ব্যবহার করা হয়। ওই এলাকায় মাদক বিক্রিতে জড়িত রয়েছে এরকম অর্ধশত শিশু-কিশোর। তেজগাঁও রেললাইন এলাকায় ডালায় সাজিয়ে গাঁজা, ইয়াবা বিক্রি করছে নারীরা। পাশাপাশি ফোনে যোগাযোগ করে যারা মাদক ক্রয় করতে যান তাদের কথানুসারে যথাস্থানে পৌঁছে দেয় শিশুরা। আনু, রহিমা, বাবুল, রফিক, ইদ্রিসসহ অনেক শিশুকে মরণনেশা বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (দক্ষিণ) মোহাম্মদ সামছুল আলম বলেন, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে দেশে চার লাখেরও বেশি শিশু-কিশোর মাদকাসক্ত। তাদের একটি বড় অংশ মাদক বিক্রি-পরিবহনে জড়িত। বিভিন্ন কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য শিশুদের ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিপথগামী করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status