প্রথম পাতা

সুফিয়া কামাল হলে প্রতিবাদকারীরাই এখন আতঙ্কে

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

২০ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ও ছাত্রলীগ নেত্রীর ‘নির্যাতনের’ প্রতিবাদ করে এখন আতঙ্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের সাধারণ ছাত্রীরা। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ২৬ জনকে। ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত জাহান এশাকে হেনস্তার ঘটনায় ২৬ শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে তাদের শোকজ করা হবে। অন্যদিক যার নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় এখন তোপের মুখে পড়েছে সাধারণ ছাত্রীরা সেই ইফফাত জাহান এশাকে পুনরায় পদে বহাল করেছে ছাত্রলীগ। এখন চলছে হলে ওঠানোর তোড়জোড়।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের আন্দোলনে অংশ নেয়া সাধারণ ছাত্রীদের গত ৮ই এপ্রিল থেকেই মারধর, জুনিয়রদের সামনে সিনিয়রদের কান ধরে উঠবোস করানোসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছিলেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১১ই এপ্রিল দিবাগত রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলের কয়েকজন সাধারণ ছাত্রীকে নিজ কক্ষে মারধর করেন এশা। এক পর্যায়ে এক ছাত্রীর চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেরে এশার কক্ষের সামনে গিয়ে জড়ো হয় হলটির পলিটিক্যাল ও সাধারণ ছাত্রীরা। ছাত্রী নির্যাতনের দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতার ওইদিন সম্মিলিত প্রতিবাদ করেন তারা।
এদিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গেলে ঘটে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হেনস্তা করা হয় এশাকে। যেখানে মাত্রা ছাড়িয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা। অন্যদিকে এশার কক্ষে সাধারণ ছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করতে গিয়ে জানালায় লাথি দিয়ে পা কেটেছেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোর্শেদা খানম। গুজব রটে যায় রগ কেটেছেন এশা। যদিও পরবর্তীতে রগ কাটা নয়, জানালায় পা কেটেছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন মোর্শেদা নিজেই। হলটির একাধিক সাধারণ ছাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, এশার সঙ্গে পরবর্তীতে যা হয়েছে সেটি নিন্দনীয়। তাই বলে- হলে এশার দীর্ঘদিনের অপকর্মের বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই। ওইদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ছাত্রী (যিনি ছাত্রলীগেরও পদধারী নেত্রী- এখন বহিষ্কৃত) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এশা হল সভাপতি হওয়ার ৬ মাস পর থেকেই হলটিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সময় তুচ্ছ কারণে ছাত্রীদের গায়ে হাত তুলেছেন। কারণে-অকারণে সিটে ওঠানো নামানোর কাজও করেন এশা।’ তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারাই অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের নানাভাবে জবাবদিহিতা নিতেন এশা। তিনি প্রথম থেকেই এ যৌক্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। আর এটি তীব্রতর হয় ৮ই এপ্রিল থেকে। নিজ কক্ষে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়া ছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের গালিগালাজের একটি অডিও রেকর্ড ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। সেটি নিশ্চয় আপনারা শুনেছেন। এখনো আমাদের নিয়মিত হুমকি দেয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে। শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।’ ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত কলা অনুষদের এক ছাত্রী বলেন, ‘ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটি করে নাকি আমাদের বহিষ্কার করেছে, অথচ তদন্ত কমিটির কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এটি করেছে সেটি স্পষ্ট। এশা তার ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরেই আমাদের বহিষ্কার করিয়েছে। এখন শুনছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ২৬ জনকে চিহ্নিত করেছে, সেখানেও হয়তো আমাদের নামই থাকবে।’ হলটির তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, ‘এশা হলে ফিরলে সাধারণ ছাত্রীদের ওপর আগের থেকে কয়েকগুণ চড়াও হবে। আমাদের নানা ধরনের হুমকিও দেয়া হচ্ছে। এখন নতুন আতঙ্ক শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ২৬ জন চিহ্নিত করা। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।’ বহিষ্কৃত এক সহ-সভাপতি বলেন, ‘এমনি সংগঠনের পদ হারিয়েছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এক পেশে আচরণ করছে। তারা এশার আগের কর্মকে প্রকারান্তরে বৈধতা দিচ্ছে। আর আমাদের সবাইকে দোষী চিহ্নিত করছে। ভয়ে আছি কখন আবার ছাত্রত্ব বাতিল হয়।’
এদিকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী শারমিন মনিরা হল ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়েও বলির পাঁঠা হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি গত ৯ই এপ্রিল রাতে হল ত্যাগ করি এবং চিকিৎসার জন্য ভারতে আছি। অবাক হলাম ছাত্রলীগ হল সভাপতিকে হেনস্তার ঘটনায় আমাকে বহিষ্কার করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠনের থেকে এ ধরনের আচরণে আমি খুবই হতাশ।’ সংগঠন থেকে বহিষ্কার হওয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক খালেদা হোসাইন মুন দীর্ঘদিন ধরে হলে থাকেন না। অথচ তাকেও একই ঘটনায় স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছেন মুন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। আমার কোনো বক্তব্যও নেয়নি। ফলে আমি দোষী না, নির্দোষ বা আমি কি দোষ করেছি তা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছি। ঘটনায় প্রকৃত যারা দোষী আমি তাদের শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু যে ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই সেখানে একটি অসম্পন্ন তদন্তে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে গঠনতন্ত্র বহির্ভূতভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
গতকাল হলের একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ওই ঘটনার পর থেকে অনেকে হল ছেড়েছেন। এখনো হলে ফেরেননি। সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। একদিকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এশার কর্মকে বৈধতা দিয়ে ২৬ জনকে চিহ্নিত করা। গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি থেকে ২৬ জনকে চিহ্নিত করা হয়, যারা এশাকে হেনস্তার ঘটনায় জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়াও এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। গতকালের শৃঙ্খলা কমিটির একটি সূত্র জানায়, হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারের পক্ষে ছিলেন না বলে চিহ্নিত ২৬ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকে শৃঙ্খলা কমিটি। এছাড়াও গত ১২ তারিখ হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান হলের সাধারণ ছাত্রীদের নিয়ে এক সাধারণ সভার আয়োজন করে। যেখানে শিক্ষার্থীরা এশার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন। সেই সাধারণ সভায় সুফিয়া কামাল হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ম্যাম আমরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হল চাই’। সেখানে কেন সিট বাণিজ্য থাকবে? কেন পলিটিক্যাল ফ্লোর এবং নন পলিটিক্যাল ফ্লোর থাকবে। আমরা এখানে সিটের আশায় উঠেছি, রাজনীতি করার জন্য উঠিনি। একজন পদত্যাগ করেছে। আরো একজন হলে আছে। তারা আমাদের সমস্যা করবে। আমাদের দায়ভার কে নিবে।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status