প্রথম পাতা

বড় পরিবর্তনে ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২০ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন

দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে (আইবিবিএল) শীর্ষ পদে বড় রদবদলে আবারো অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান হঠাৎ করেই মঙ্গলবার পদত্যাগ করার পর নতুন করে এই অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আরো পদত্যাগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের মাঝে এক ধরনের ছাঁটাই     
আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে নগদ টাকার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। অন্যদিকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাংকটি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। ‘ইসলামী ব্যাংকে যারা আমানত রেখেছেন তারা দ্রুত উঠিয়ে নেন’ এভাবে প্রচারণা চলছে ফেসবুকে। এর পাশাপশি পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দামও কমছে। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে ইসলামী ব্যাংকের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। কিন্তু অল্প সময়ে সেই ধারাবাহিকতা নষ্ট হতে চলেছে। ব্যাংকটিতে বর্তমানে চলছে চরম অস্থিরতা। একে একে বিদায় নিচ্ছেন ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ফলে ব্যাংকটি ইমেজ সংকটে পড়েছে। পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তার সংকটের আশঙ্কা করছেন ব্যাংকের পুরনো কর্মীরা।
আইবিবিএল বিভিন্ন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করে ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগে ব্যাংকের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। কখন কি হয় এই নিয়ে আতঙ্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ছাড়া ব্যাংকটির বেশির ভাগ শাখায় সকলের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতার পাশাপাশি গ্রাহকদের উপস্থিতিও কম লক্ষ্য করা গেছে।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ই জানুয়ারি এভাবেই হঠাৎ বড় পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে আসেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। দায়িত্ব নেয়ার এক বছর ৪ মাসের মাথায় সরে দাঁড়ালেন তিনি। শুধু আরাস্তু খানই নয়; ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামও একই সময়ে পদত্যাগ করেন। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেও নতুন চেয়ারম্যান এসেছেন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকে আরো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আগামী ২৫শে এপ্রিল ব্যাংকটির বোর্ড সভা। তাই ব্যাংকের সবাই ওই সভার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সূত্র জানায়, গত বছর ব্যাংকটির মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তনের পর অস্থিরতা শুরু হয়। ইতিমধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। অনেকে বদলি হয়েছেন। আবার নতুন নিয়োগও দেয়া হয়েছে। আগে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ সীমার নিচেই থাকত। গত বছর মালিকানায় পরিবর্তন আসার পর থেকে ব্যাপকহারে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণের সীমাও অতিক্রম করে গেছে।
প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। তবে সার্বিক আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। সমপ্রতি এ হার ১ শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ইসলামী ব্যাংকের ঋণ ৮৯ শতাংশের বেশি রয়েছে তাদের আগামী বছরের মার্চের মধ্যে সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিনিয়োগ (ঋণ) দিয়েছে ৬৯ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৯১.৪৯ শতাংশ, যা নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। তারা ওই সীমার চেয়ে ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকা বেশি বিতরণ করেছে। এদিকে ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) বর্তমানে ৯২ শতাংশ হয়ে গেছে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত হারের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে ৫০০ কোটি টাকা তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
ব্যাংকটি সংকট মেটাতে বিভিন্ন উপায় খুঁজছে। আগামী ২৫শে মার্চ অনুষ্ঠিতব্য বোর্ড সভায় ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএমে) তারিখ এবং শেয়ার হোল্ডারদের কত শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হবে সে বিষয়ে আলোচনা হবে। এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে শুধু বোনাস শেয়ার বা স্টক ডিভিডেন্ড দেয়া হবে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এএমডি) ডিএমডি পর্যায়ের ৪ জন এবং একজন এসইভিপি পদত্যাগ করেছেন। তারা কী কারণে পদত্যাগ করেছেন তা পদত্যাগকারী ও ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এর পর গত মঙ্গলবার পদ ছাড়েন চেয়ারম্যান আরাস্তু খান। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নাজমুল হাসান ও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন নতুন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের বেশ কিছু কমিটিতেও রদবদল হয়েছে। সেলিম উদ্দিন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা হতাশা প্রকাশ করছেন। কারণ, শেয়ারবাজারের অন্তর্ভুক্তির পর থেকে ভালো শেয়ার হিসাবে সবসময় বিনিয়োগকারীরা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে আসছেন। কিন্তু গত বছরের পরিবর্তন শুরু হওয়ার পর থেকে শেয়ারটির দাম কেবল কমছেই। অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস লভ্যাংশও গত বছর পাননি তারা।
এদিকে পুঁজিবাজারে শেয়ারের দামও কমছে। গতকাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি দাম ছিল ২৭ টাকা ২০ পয়সা। এর আগের দিন ছিল ২৭ টাকা ৮০ পয়সা। গত বছরের ৬ই জানুয়ারি যেখানে শেয়ারের দাম ছিল ৩১ টাকা ৪০ পয়সা। গত বছরে এ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সর্বোচ্চ দাম হয়েছিল ৩৯ টাকা ৫০ পয়সা।
কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কখন কার চাকরি যায় সেই বিষয়ে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। ঠিক কী কারণে চাকরি হারাতে হচ্ছে সেটিও তাদের কাছে অজানা। অপেক্ষাকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে এই আতঙ্ক অনেক বেশি।
পদত্যাগের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান কোনো চাপের কথা অস্বীকার করে বলেন, ব্যক্তিগত কারণেই পদত্যাগ করেছি।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত বোর্ডসভায় ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আরাস্তু খান। তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হকও সেদিন পদত্যাগ করেছিলেন। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারি ও অস্থিরতা চলার মধ্যেই তখন ইসলামী ব্যাংকে এ পরিবর্তন এসেছিল।
সরকারি বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় এ খাতে অস্থিরতা চলছে গত বছর থেকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ ব্যাংক খাতকে এতিমের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে, এর রক্ষকরাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী এবং জনতা ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আলোচনা সমালোচনার মধ্যে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পায়। সমালোচনার মুখে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়া ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়ে এখন গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এতে ওই ব্যাংকের গ্রাহকরা বিপাকে পড়েছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status