শেষের পাতা

নি র্বা চ নী হা ল চা ল, খুলনা ৩

আলোচনায় সাবেক দুই ছাত্রনেতা

রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে

১৯ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

বন্দরনগরী খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানার একাংশ নিয়ে গঠিত খুলনা-৩ আসন। সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৫নং ওয়ার্ড ও দিঘলিয়া উপজেলার আড়ংঘাটা ও যোগীপোল ইউনিয়ন রয়েছে এর মধ্যে। নির্বাচনে শ্রমিক ভোট এখানকার বড় ফ্যাক্টর। বন্ধ মিল-কলকারখানা চালু, বকেয়া মজুরি ও দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক অধ্যুষিত এ এলাকা প্রায়ই আন্দোলনমুখর থাকে। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তাই আগেভাগেই শুরু হয়েছে নির্বাচনী তোড়জোড়। এবার প্রধান দুই দলকে ভাবিয়ে তুলেছে তরুণ নেতাদের আগাম প্রচার-প্রচারণা। বিশেষ করে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুলের পক্ষে নেতাকর্মীরা মাঠে নামায় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দেখা দিয়েছে।
খুলনা-৩ আসন বেশিরভাগ সময় বিএনপির দখলে থাকলেও ৯ম ও ১০ম সংসদ নির্বাচন ছাড়া ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ আসনে জয়লাভ করে।
১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির টিকিটে বিজয়ী হন তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব মো. আশরাফ হোসেন। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী হিসাবে ২০০৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তিনি দল থেকে বহিষ্কার হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। পরাজিত হন ১৬ হাজার ৫১০ ভোটের ব্যবধানে। তিনি পেয়েছিলেন ৫৮ হাজার ১৭৭ ভোট। আর আওয়ামী লীগের বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ৭৪ হাজার ৬৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।

আসনটিতে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী, বর্তমান এমপি বেগম মন্নুজান সুফিয়ান আবারো প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ শুরু করেছেন। এলাকায় দীর্ঘদিন তার শক্ত অবস্থান থাকলেও এবার অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগগুলোতে ভূমিকা রাখা, তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ। তাছাড়া গত টার্মে মন্ত্রী থাকাকালীন নিজ ভাইকে ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ এবং ভাইয়ের খবরদারি ও টেন্ডারবাজির কারণে সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে আমি ছিলাম। এখনও আছি। আমার অবদানের কথা চিন্তা করে এবারও আমাকে দল মনোনয়ন দিবে।
এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সাবেক ছাত্রনেতা এসএম কামাল হোসেন। তার পক্ষে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতা-কর্মীরা প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। ওয়ার্ড পর্যায়ে স্থানীয় নেতারা ইতিমধ্যেই প্রার্থী পরিবর্তন ও এস এম কামালকে মনোনায়নের দাবিতে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডে লিখিত দাবি জানিয়েছে। ৮০’র দশকে খুলনায় দাপটের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করা কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় দলীয় কর্মকাণ্ডে তার সরব উপস্থিতি ছাড়াও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তবে তিনি খুলনার চেয়ে ঢাকাতেই সময় কাটান বেশি। এসএম কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি দলের জন্য রাজনীতি করি। ছাত্রজীবন থেকে খুলনায় রাজনীতি করেছি। খুলনার মাটি-মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। দলীয় কারণে ঢাকায় অবস্থান করলেও এলাকায় উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি। তবে প্রার্থিতার বিষয়টি নির্ভর করবে দলীয় সভানেত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর। দল মনোনয়ন দিলে কাজ করবো। না পেলে যাকে দিবে তার পক্ষে কাজ করবো।
অপরদিকে দৌলতপুর থানা সভাপতি ও বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সভাপতি শেখ সৈয়দ আলীকে মনোনয়নের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ। শেখ সৈয়দ আলী বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের জন্য আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি। এবারও দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো।

এদিকে ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে মনোনয়ন পাবার ক্ষেত্রে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। এখানে কমপক্ষে পাঁচজন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক এমপি কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল ইসলাম বকুল, মহানগর কমিটির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম, মহানগর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠু এবং মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলমের নাম শোনা যাচ্ছে।

তবে, দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা না কাটলে শেষ মুহূর্তে চতুর্মুখী কোন্দল সামাল দিতে বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবেক এমপি আলী আসগর লবী মনোনয়ন পেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম রাজপথে সক্রিয় থাকলেও তরুণ নেতৃত্বের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আগের মতো নেই।
কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম বলেন, ‘এই আসনের সাবেক এমপি হিসেবে আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হতে চাই। দলের ঊর্ধ্বতন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করেই কাজ করছি। এর আগেও দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছি, তাই এবারও আশাবাদী।’
এবার আলোচনায় উঠে এসেছে ৯০’র দশকের ছাত্রনেতা রকিবুল ইসলাম বকুলের নাম।
বাবার চাকরির সুবাদে বকুল পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতেন খালিশপুরে। এখানেই বকুলের জন্ম। তিনি ছোটবেলা থেকে খালিশপুরে বেড়ে উঠেছেন। খালিশপুরের রোটারী স্কুলে প্রাথমিক, খালিশপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। খুলনার সরকারি বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স-মাস্টার্স করেন। ২০০০ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল সংসদের জিএস বকুল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন জরিপ টিমের কার্যক্রম পরিচালনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর ওয়ান ইলেভেনের সময়ে আত্মগোপনে থাকা বকুল নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন বহুদিন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ঈদের পর তিনি খুলনায় আসেন। তখন থেকে তার অনুসারীরা নড়েচড়ে বসেছেন। ঢাকাতে থাকলেও খুলনার বিএনপির রাজনীতির নেপথ্যে রয়েছে তার অগ্রণী ভূমিকা। মহানগর ও জেলা যুবদল ও ছাত্রদলের কমিটি গঠনে বকুলের ভূমিকা ওপেন সিক্রেট। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বেড়ে ওঠা কৈশোর ও ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি খুলনার শিল্পাঞ্চলে তার হয়ে নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন। তার পক্ষে ছাত্রদল, যুবদলের সাবেক এবং বর্তমান নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ কাজ করছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী এলাকা ছেয়ে গেছে তার ছবি সংবলিত পোস্টার ও ফেস্টুনে।
রকিবুল ইসলাম বুকল বলেন, আমার জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে খালিশপুরে। অনেক বাধা-বিপত্তির মাঝেও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। আওয়ামী দুশাসনের বিরুদ্ধে খুলনার নেতাকর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। আগামী নির্বাচনে আমাকে প্রার্থী করার জন্য তৃণমূল থেকে দাবি উঠেছে। তবে, এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান কাজ ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। তারপরে তাকে নিয়ে আগামী নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে দুশাসনের জবাব দেয়া হবে। নির্বাচনের প্রার্থীর ক্ষেত্রে দলীয় হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেবে তা আমি মেনে নেবো।
বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আশির দশকের ছাত্রনেতা অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম। সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী, দুর্দিনে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করাসহ দলকে এলাকায় মজবুত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কারাভোগ করেছেন বার বার। টকশোতে সরকার বিরোধী জোরালো বক্তব্য দিয়ে তিনি সুশীল সমাজের মাঝে তার নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, প্রচার-প্রচারণায় পিছিয়ে থাকলেও অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলামের মাঠপর্যায়ে ছিল শক্ত অবস্থান। তবে, প্রার্থী হিসেবে বকুলের নাম আসায় তার অনুসারীদের একটি অংশ এখন বকুলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে।
তারিকুল ইসলাম বলেন, আমি নির্বাচনের জন্য নয়, দলের জন্য কাজ করছি। আর এটি দলীয় নির্বাচন, এখানে ব্যক্তি প্রচারের চেয়ে দলের প্রচার বেশি প্রয়োজন। দলের কাছে আমি মনোনয়ন চাইবো।
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির মহানগর কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠু। মহানগর বিএনপির একটি পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন এই তরুণ নেতা। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একটি অংশের সঙ্গে তার শক্ত যোগাযোগ রয়েছে। মহানগর বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলেও নিজ অনুসারীদের নিয়ে পৃথকভাবে দলীয় প্রতিটি কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। আরিফুর রহমান মিঠু বলেন, হামলা-মামলাকে ভয় না করে আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ছিলাম। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নেও মাঠে আছি। বিগত সময়েও এই আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো।
এ আসনে বিএনপির মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর যবুদলের সাবেক সভাপতি ফখরুল আলমের নাম প্রথম দিকে জোরালো ভাবেই উঠে এসেছিল। যুবদলের সাবেক সভাপতি হবার সুবাদে ফখরুল আলমের পক্ষে যুবদলের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু বকুলের নাম আলোচনায় চলে আসায় তার অনুসারীদের একটি অংশ এখন বকুলের পক্ষ নিয়েছেন। তবে দক্ষ সংগঠক হিসেবে দলের মধ্যে ফখরুল আলমের অবস্থান রয়েছে। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হলেও এখান থেকে মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু, কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মোল্লা মুজিবুর রহমান ও মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক মোল্লা শওকাত হোসেন বাবুল। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল আওয়াল এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ, সভা, বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) জেলা সাধারণ সম্পাদক এসএ রশিদকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status