শেষের পাতা

বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারি

আদালতের বাইরে সমাধানের দিকে চোখ

মানবজমিন ডেস্ক

১৮ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

তিন বছর আগের একটি সাইবার ডাকাতির ঘটনায় মার্কিন বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গো ও ইকুয়েডরের একটি ব্যাংক আদালতের বাইরে মীমাংসায় পৌঁছেছে। এই ঘটনায় আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। সাইবার ডাকাতির কবলে হারিয়ে যাওয়া ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পুনরুদ্ধারে মামলা করার প্রস্তুতি
নিচ্ছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখন আদালতের বাইরে সমাধানের বিষয়টিও মাথায় রাখছে বাংলাদেশ। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। খবরে বলা হয়, ২০১৫ সালে বাংকো দেল অস্ট্রোর বিভিন্ন একাউন্ট থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার
প্রতারণার মাধ্যমে অন্য একাউন্টে ট্রান্সফার করে উত্তোলন করা হয়। এ ঘটনায় ইকুয়েডরের বাংকো দেল অস্ট্রো মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গোর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই ট্রান্সফার অনুমোদন দেয়ায় ওয়েলস ফার্গোর বিরুদ্ধে মামলা করে ইকুয়েডরিয়ান ওই ব্যাংক। তবে মামলায় বিচারকাজ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে, ফেব্রুয়ারিতে আদালতের বাইরে মীমাংসায় পৌঁছে দুই পক্ষ।
বাংলাদেশের বিষয়টিও অনেকটা একই রকম। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এরপর তারা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে বোকা বানিয়ে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ট্রান্সফার করে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের কিছু একাউন্টে। ওই একাউন্টগুলো খোলা হয়েছিল ভুয়া নাম ব্যবহার করে। ওই বিপুল অর্থ মিলিয়ে যায় ম্যানিলার ক্যাসিনো শিল্পে। কিছু অর্থ পরে উদ্ধার করা হয়, তবে ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের কোনো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি।
ওই হ্যাকিংয়ের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত সত্ত্বেও এখনো কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়নি। এই দুই বছরে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও অর্থ স্থানান্তরে ব্যবহৃত সুইফট নেটওয়ার্কের কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করেছে। বাংলাদেশ ওই অর্থ উদ্ধারে ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছে। বাংলাদেশ এই ইস্যুতে কী পদক্ষেপ নেয় এবং কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়, তার দিকে গভীর নজর রাখছে বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, আইনি পথে একবার নজির সৃষ্টি হয়ে গেলে তা পরবর্তী ও পূর্ববর্তী ঘটনায়ও ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান বলেন, ‘এটা বেশ কৌশলপূর্ণ একটা ইস্যু। আমরা আমাদের কৌশল প্রকাশ করে দিতে পারি না। কিন্তু হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকটি ঘটনা পর্যালোচনা করছি, ইকুয়েডরের ঘটনা সহ।’
বাংলাদেশ এখনো কোনো আইনি পদক্ষেপ না নিলেও, ব্যাংকার ও আইনজীবীরা ভেবেছিলেন, বাংকো ও ওয়েলস ফার্গোর মধ্যকার মামলা বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ওই বিরোধ আদালতের বাইরে দুই পক্ষ মিটিয়ে ফেললেও, আইনজীবী ও ব্যাংকাররা মনে করেন, এই মীমাংসা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ওয়েলস ফার্গো কোনো না কোনো উপায়ে বাংকোকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আদালতের শুনানি পেতে ও চুরি হওয়া অর্থ ঠেকাতে রিজাল ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি প্রমাণ করতে বাংলাদেশের বেগ পেতে হতে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান ফ্রেশফিল্ডস ব্রাখাওস ডেরিংগার এলএলপি’র জ্যেষ্ঠ সহযোগী পিটার জ্যাফে বলেন, ‘আদালতের বাইরে মীমাংসা করার অনেক কারণ থাকে মানুষের। এখানে, অনেক আইন আছে যেটা প্রযোজ্য হতে বা না হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে রিজাল ব্যাংক কিন্তু হ্যাকের শিকার হয়নি। কেউ হয়তো মনে করতে পারে যে, যখন নিজেদের একাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের অর্থ আসা শুরু হলো, রিজাল ব্যাংকের ভিন্ন কিছু করা উচিত ছিল। সেটি কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কিছু নয়। আর আমি মনে করি না যে, বাধ্যবাধকতা ও অধিকারের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আপনি সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন।’
নিউ ইয়র্কের ইউনিফর্ম কমার্শিয়াল কোডে বলা আছে, কোনো ব্যাংক যদি চুরির শিকার হয়, তাহলে ব্যাংককে অবশ্যই গ্রাহকের অর্থ পরিশোধ করতে হবে, যদি না অর্থ উত্তোলন ভেরিফাই করতে দুই পক্ষের ঠিক করা বিশেষ প্রটোকল ব্যবহার করেই চুরির ঘটনা ঘটে। তবে গ্রাহক পাল্টা যুক্তি দেখাতে পারে যে, নিরাপত্তা প্রটোকল বাণিজ্যিকভাবে যৌক্তিক ছিল না।
২০১৬ সালে বাংকোর অভিযোগ খারিজ করতে ওয়েলস ফার্গো আদালতে চেষ্টা চালায়। আদালত ওয়েলস ফার্গোর আপত্তি বাতিল করেন এই যুক্তিতে যে, সুইফট সিস্টেমই নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে আদালত রুল দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাট হয়েছে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে। নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ বারবার জোর দিয়ে বলেছে যে, তাদের প্রত্যেক বিদেশি গ্রাহকই সুইফট প্রটোকল ব্যবহার করার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকাররা যখন ভুয়া ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট পাঠায়, তখন তা সুইফটের মাধ্যমে ভেরিফাইড হয়। এরপর সেই রিকুয়েস্ট অনুযায়ী নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ অর্থ পাঠায় রিজাল ব্যাংকে।
এখন রিজাল ব্যাংকের কতটা বাধ্যবাধকতা ছিল ওই অর্থ উত্তোলন ঠেকিয়ে দেয়ার বা রিজাল ব্যাংকের ওপর মার্কিন আইন কতটা প্রযোজ্য হবে, তা স্পষ্ট নয়। রিজাল ব্যাংক বলছে, আমেরিকান আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়েছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের যেকোনো ধরনের মামলার বিরুদ্ধে শক্ত ডিফেন্স আছে তাদের।
সোমবার ব্যাংক এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ক্ষতি বা চুরি নিয়ে রিজাল ব্যাংকের ওপর চাপানো যায় এমন কোনো দায় নেই। আমরা এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করছি যে, রিজাল ব্যাংক ছিল শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক। এর মানে হলো, অর্থ প্রেরণের যেই রিকুয়েস্ট বা ইন্সট্রাকশন, যা হ্যাকিং-এর মাধ্যমে করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, তা আমাদের দ্বারা হয়নি।
চুরির ঘটনার পরপর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফটের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয়। তবে দুই পক্ষ এই অর্থ উদ্ধারে সহায়তা দেয়ার পর পারসপরিক সম্পর্ক উষ্ণ হয়েছে। তবে বাংকো ও ওয়েলসের মীমাংসার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি নিউ ইয়র্ক ফেড ও সুইফট।
সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষটি ঘটেছে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি আরো বলেন, মামলার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি নিশ্চিত যে, আমরা মামলা দায়ের করবো। বাংলাদেশে এ নিয়ে হতাশা রয়েছে। একসঙ্গে আমাদের এতদিনে আরো ভালো কিছু করা উচিত ছিল।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status