শেষের পাতা

সৌদিতে নিহত বাংলাদেশিদের বাড়িতে শোকের মাতম

স্টাফ রিপোর্টার

১৬ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:৪২ পূর্বাহ্ন

সৌদি আরবে অগ্নিকাণ্ডে নিহত বাংলাদেশিদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের আহাজারি আর আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠছে বাতাস। শুক্রবার রিয়াদের কাছে ওই অগ্নিকাণ্ডে নয় বাংলাদেশি নিহত হয়েছে।

বিয়ানীবাজার (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, রিয়াদে ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত বিয়ানীবাজারের জুবের আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শুক্রবার সকালে সৃষ্ট এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অন্তত পাঁচ বাংলাদেশি। সকাল ৭টার দিকে রিয়াদের আল নুরা ইউনিভার্সিটির আবাসিক এলাকায় শ্রমিকদের বসবাসের একটি   ভবনে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

নিহত জুবের আহমদ চৌধুরী (২৬) বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের সাদিমাপুর গ্রামের মরহুম আজাদ চৌধুরী মাস্টারের ছেলে। তারা চার ভাই ও দুই বোন। প্রায় বছরখানেক আগে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান। নিহতের চাচাতো ভাই জামিল আহমদ জানান, জমিজমা বিক্রি করে জুবের সৌদি আরবে গেলেও সেখানকার অবস্থা ছিল খুব খারাপ। দেশে তিনি তেমন বেশি টাকা পয়সা পাঠাতে পারেননি। এমনকি তার আকামা পর্যন্ত লাগিয়ে দেয়নি সেখানকার কোম্পানি।

নিহতের ভাই ইকবাল চৌধুরী জানান, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে এখনো কেউ যোগাযোগ করেনি। তবে, যে এজেন্সির মাধ্যমে তাকে সেখানে পাঠানো হয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তার ভাইয়ের মরদেহ কবে বাংলাদেশে আসবে, তা সঠিকভাবে জানেন না তিনি। তার অভিযোগ, রাজধানী ঢাকার একটি এজেন্সি তার ভাইকে ক্যাবলস কোম্পানির কাজ দেবে বলে সৌদি আরবে পাঠালেও সেখানে জুবেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে।

নিহত জুবের চৌধুরীর মা গুলবাহার চৌধুরী বলেন, তার ছেলের লাশ একটি হাসপাতালে রাখা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কবে তিনি তার ছেলের মরদেহ দেখবেন, তা জানেন না তিনি। তার ওই ছেলেই পরিবারের হাল ধরতে সৌদিতে যায়। জমিজমা এবং ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক গুলবাহার চৌধুরী। ছেলের মরদেহ দেশে আনতে তিনি সরকারের সহযোগিতা চান এবং যেসব ভুয়া এজেন্সি মানুষকে বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয় তাদের বিচার দাবি করেন গুলবাহার চৌধুরী।  

স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার রাকিব হোসেন (২২)-এর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সে উপজেলার জয়মণ্ডপ ইউনিয়নের চর-দুর্গাপুর গ্রামের জালাল উদ্দিন পালের ছেলে। পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রিয়াদ বিমানবন্দর সংলগ্ন  ইউসিভার্সিটি এলাকার একটি আবাসিক ভবনে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে ওই রুমে থাকা বাংলাদেশিরা হতাহত হয়। জয়মণ্ডপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শাহাদাৎ হোসেন জানান, দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাকিব অবিবাহিত ছিল। মা-বাবা ও সংসারের সুখের জন্য বেশ কয়েক বছর হয় চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে যায়। কিন্তু সুখের নাগাল পাওয়ার আগেই পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল রাকিব। মা-বাবাকে দেখভাল ও সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে রাকিবের স্বজনরা। রাকিবের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
রূপগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সৌদি আরবের রিয়াদে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার বিরাব এলাকার আব্দুল মজিদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে হারিয়ে মা জৈবুন্নেছা কাঁদতে কাঁদতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছেন। বাবা আওলাদ হোসেন ছেলেকে হারিয়ে শুধু নির্বাক হয়ে সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। স্ত্রী ময়না বেগম স্বামীকে হারিয়ে কেঁেদ কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে ফেলেছেন। ছয় বছরের একমাত্র মেয়ে আমেনাকে নিয়ে এখন কিভাবে তার সংসার চলবে এবং ধার ও সুদের উপর টাকা নিয়ে স্বামী আব্দুল মজিদ পরিবারের সুখের জন্য বিদেশ গিয়েছিল। সে টাকা কিভাবে শোধ করবে সেই চিন্তায় স্তব্ধ ময়না।

কাঞ্চন পৌরসভার বিরাব লালটেক গ্রামের আওলাদ হোসেনের মেজ ছেলে আব্দুল মজিদ খান সাত বছর আগে পার্শ্ববর্তী শিমুলিয়া এলাকার গোলজার ভূইয়ার মেয়ে ময়না বেগমকে বিয়ে করেন। বর্তমানে আমেনা আক্তার নামে ছয় বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সে স্থানীয় বিরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজের ভিটে-মাটি ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের। একটি ছোট টিনের ঘরে পরিবার নিয়ে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বসবাস করতো আব্দুল মজিদ। হঠাত মাথায় চিন্তা ঢুকে পরিবার ও নিজেকে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সৌদি আরব কাজের জন্য পাড়ি জমাবেন। আত্মীয় স্বজন, এনজিও ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সুদের উপর চার লাখ টাকা নিয়ে চলতি বছরের ৭ই জানুয়ারি পার্শ্ববর্তী পলাশ থানাধীন ডাঙ্গা কেন্দুয়াবো এলাকার নাজিমউদ্দিনের মাধ্যমে কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান সুদূর সৌদি আরবের রিয়াদ। সেখানে প্রায় তিন মাস কোনো কাজ পাননি মজিদ। নিজ বাড়ি থেকে টাকা পাঠালে পেটে খাবার জুটতো তার। ১২ দিন আগে সেখানকার একটি ইউনিভার্সিটিতে ক্লিনারের কাজ পায় সে। রিয়াদের আল নুরা ইউনিভার্সিটি আবাসিক এলাকায় একটি ভবনের রুমে ৭/৮ জনের সঙ্গে থাকতো সে। প্রতিদিনের মতো রাতে কাজ শেষ করে শুক্রবার সকালে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হঠাত একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন আব্দুল মজিদ খানসহ  রুমের সবাই। দুপুরে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একই ভবনে থাকা রাশেদ খান নামে এক যুবক আব্দুল মজিদের বড় ভাই বাছেদ আলীকে আব্দুল মজিদের মৃত্যুর খবর জানায়। এরপর থেকে নিহতের পরিবারের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে নিহত আব্দুল মজিদের লাশ রিয়াদের সিমুচি হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। এখন শুধু দেশে লাশ আনার জন্য অপেক্ষা পরিজনদের।

 এ ব্যাপারে নিহত মজিদের স্ত্রী ময়না বেগম বলেন, আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়া টাকা উপার্জন করে একমাত্র আদরের মেয়ে আমেনাকে অনেক বড় শিক্ষিত করবো। বাড়িঘর একটু ভালো করবো। সংসারে সব কষ্ট দূর হইবো। এখন সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। একদিকে স্বামীকে হারিয়ে ও অন্যদিকে স্বামীর ধার করা টাকা কিভাবে শোধ করবে সেই চিন্তায় হতাশার ছায়া তার চোখে।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সৌদি আরবে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত আব্দুল মজিদের পরিবারের খোঁজ খবর নিচ্ছি। লাশ দেশে আনাসহ যেকোনো ব্যাপারে তার পরিবারের লোকজন কোনো প্রকার সহায়তার প্রয়োজন মনে করলে অবশ্যই সহায়তা করবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status