বই থেকে নেয়া
বই থেকে নেয়া
ত্রিশ লাখ শহীদের দেশ বায়াফ্রা (পর্ব-৩)
নিজস্ব প্রতিনিধি
১৫ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ৪:৩১ পূর্বাহ্ন
আচিবিকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক আফ্রিকান লেখা-লেখির জনক এবং আফ্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ গাল্পিক। তার উপরে তার কাজ সম্পর্কে গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে লেখা-লেখি হয়েছে। ১৯৯২ সনে তিনি প্রথম জীবিত লেখক যাকে আলফ্রেড এ নফ প্রকাশিত ‘এভরি ম্যানস লাইব্রেরি’ উপস্থাপন করা হয়। তার ষাটতম জন্মদিন নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় উদযাপন করেছিল। তার জন্মদিনের থিম ছিল ‘আন ইনটারন্যাশনাল হুজ হু ইন আফিক্রান লিটারেটার’। এ বিষয়ে একজন পর্যবেক্ষকের মতামত ছিল আফ্রিকা মহাদেশের সাহিত্যে অন্য কোনো লেখককে নিয়ে ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ঘটেনি।
অনাগত প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন একটি ব্লু-প্রিন্ট। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কেন্ট তাকে একটি সম্মানসূচক ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ওই উৎসবে প্রফেসর রবার্ট গিবসন বলেছিলেন এই নাইজেরিও লেখক আফ্রিকান তরুণ লেখকদের কাছে একজন চিরকালীন গুরু হিসেবে নন্দিত হবেন। তাদের কাছে তিনি হয়ে থাকবেন অনুপ্রেরণার উৎস। এমনকি আফ্রিকার বাইরে তার প্রভাব ভালোভাবে অনুভূত হবে।
ঔপন্যাসিক মার্গারেট আতউত তাকে একজন জাদুকারী লেখক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মার্গারেটের কথায় আচিবি বিংশ শতাব্দীর আধুনিক লেখক। কবি মায়া আঙ্গুলুর মতে থিংস ফল এপার্ট এমন একটি বই যেখানে ‘সকল বয়সের পাঠক একটি নাইজেরিও মহাসড়কের পাশে তাদের পিতা-মাতা ভাই বন্ধুদের খুঁজে পাবেন’ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেলসন মেন্ডেলা কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবনে আচিবিকে তিনি এমন একজন লেখক হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন যা নেলসন মেন্ডেলার ভাষায় ‘যার সান্নিধ্যে কারাগারের দেয়াল ভুপাতিত হয়েছে এবং তার সাহিত্য কর্ম থিংস ফল অ্যাপার্ট বর্ণবাদের অবসানে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে তাকে উৎসাহ যুগিয়েছে।’
অপর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মোরিসন উল্লেখ করেছেন যে, তার সাহিত্যকর্ম তাকে লেখকে রূপান্তরিত করেছে এবং আফ্রিকান সাহিত্যের প্রতি তাকে প্রেমানুরাগী করেছে। আচিবি তার সাহিত্যকর্মের জন্য ডারমত কলেজ, হার্ভার্ড এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ত্রিশটিরও বেশি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে কমনওয়েরথ পোয়েট্রি প্রাইজ, আমেরিকান এডাডেমি আর্ট অ্যান্ড লিটারেচার অনারশিপ (১৯৮২), আমেরিকান একাডেমি অফ আর্ট অফ সাইন্সেস ফোরাম ওয়ানরারি মেম্বর, একডেমিক কাজের জন্য সর্বোচ্চ নাইজেরিও খেতাব দি নাইজেরিয়ান ন্যাশনাল অর্ডার অফ মেরিট, পিস প্রাইজ অফ জার্মান বুক ট্রেড, দি ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ (২০০৭) এবং ২০১০ সালে ডরোর্থি লিলিয়ান গিস প্রাইজ, ১৯৯৯ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ড ইউএনএফফির গুডউইল এম্বাসেডার নির্বাচিত হয়েছেন। আচিবি ২০০৪ ও ২০১১ সালে দুবার নাইজেরিয়ান অর্ডার কমান্ডার অফ দ্যা ফেডারেল রিপাবলিক খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ‘তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন আমি আমার নিজের রাজ্য এনামরা নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা দেখেছি যেখানে একটি ক্ষুদ্র বিশ্বাসঘাতকের দল প্রকাশ্যে জাহির করে বেড়ায় যে ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। দৃশ্যত যাদেরকে মনে হয় তারা আমার মাতৃভূমিকে দেউলিয়া এবং আইনশৃঙ্খলাবিহীন নৈরাজ্য ভূমিতে পরিণত করতে চায়। আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষমতা লোভী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ। বিশেষ করে এই ক্ষমতা লোভীদের সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপতির যদি যোগসাযোশ না থেকে থাকে তিনি যেভাবে নীরবতা পালন করছেন তাতে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।’
আচিবির সাহিত্য পর্বের পাণ্ডিত্যপূর্ণ অর্জন এবং তার বৈশ্বিক গুরুত্বের শর্তেও তিনি কখনো নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হননি। যা অনেক বোদ্ধাদের মতে তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ওলে সোয়েনকা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন তিনি তখন প্রথম আফ্রিকান নোবেল বিজয়ী হিসেবে সাইজেরি জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পিছিয়ে থাকেননি। বরং তিনি সোয়েনকাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলেছেন যেকোনো পুরস্কার লাভের জন্য সোয়েনকা অধিক যোগ্যতর। ১৯৮৮ সালে কোয়ালিটি উইকলি পত্রিকার একজন রিপোর্টার তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কখনো নোবেল পুরস্কার জয়লাভ না করার প্রতিক্রিয়া কেমন। তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন এ বিষয়ে আমার জবাব হলো নোবেল পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একটি ইউরোপীয় পুরস্কার এটি কোনো নাইজেরিও পুরস্কার নয়। এটি হেবি ওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ নয়। নাইজেরিওরা ভাবতে পারে এই লোকটি বুঝি নকট আউট হয়েছেন। আসলে বিষয়টি তেমনকিছু নয়। ২০১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর নাইজেরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুগল একটি ডুডল প্রকাশ করেছিল।
চিনুয়া আচিবির জন্ম ১৬ই নভেম্বর ১৯৩০ সালে। তিনি একজন নাইজেরিও উপন্যাসিক, কবি, অধ্যাপক এবং সমালোচক। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলিয় এ্যাডামরা অঙ্গরাজ্যের ইকব শহরে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জাতিগত সংখ্যালঘু ইকব মানুষেরা ক্যামেরুন ও গিনিতে বসবাস করেন। তাদের ধর্ম প্রাথমিকভাবে খ্রিষ্ট হলেও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ইকব মানুষদেরও নিজেস্ব ধর্ম রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার সংখ্যালঘু হিসেবে কিছু মুসলমানও রয়েছে। তাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একটি তুলনামূলক উল্লেখ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক দিনগুলোতে হরহামেশা বায়াফ্রা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিল। ১৯৬৬ এবং ১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলিয় জনগোষ্ঠী এবং ইকব অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৯৯৬৬ সালের ২৯শে জুলাই নাইজেরিও সশস্ত্র বাহিনীর একটি বিপদগামী অংশ নাইজেরিও সেনা প্রধান জেনারেল জনসনকে হত্যা করেছিল এবং সামরিক সরকার এবং বিদ্রোহী আঞ্চলিক সরকারের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে প্রতিবেশী ঘানায় চলমান শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হয়েছিল। এর পরিণতিতে পূর্বাঞ্চলিও জনগণ মূল ভূ-খ- থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং কার্যত ১৯৬৭ সালের ৩০শে মে বায়াফ্রার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। লাল সবুজে খচিত তাদের পতাকা ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রিপাবলিক ও বায়াফ্রা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত জেনারেল এমেকা বায়াফ্রার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল এবং নতুন প্রজাতন্ত্রের তিনিই রাষ্ট্র প্রধান হয়েছিলেন। এরপর শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ। ১৯৬৭ সালের ৬ই জুলাই থেকে ১৯৭০ সালের ১৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত নাইজেরিয়ান-রায়াফ্রান যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পূর্ব নাইজেরিয়ান জনগণ পরাজিত হয়েছিলেন। এর ফলে তাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। এই গৃহযুদ্ধে পূর্ব নাইজেরিয়ার লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়। এই যুদ্ধে বায়াফ্রার জনগণ বাংলাদেশের মানুষের মতই জাঁ পল সাত্রে এবং জন লেননের মতো ব্যক্তির সমর্থন পেয়েছিলেন। জন লেনন ওই যুদ্ধে বৃটিশ ভূমিকার প্রতিবাদে তাকে দেয়া অর্ডার অফ দ্য বৃটিশ এমপায়ার (এমবিই) পরিত্যাগ করেছিলেন। বায়াফ্রার জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম অবশ্য আজও শেষ হয়নি। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে বায়াফ্রার প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল এমেকা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে নাইজরিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। জেনারেল এমেকা ২০১১ সালে ৭৮ বছর বয়সে বৃটেনে মারা যান। তবে, লক্ষণীয় যে নাইজেরিয়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন বায়াফ্রা রাষ্ট্র গঠন করা সত্ত্বেও নাইজেরিও সশস্ত্র বাহিনী পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তার অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ করেছে। দেশটির পাঁচটি পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে তার মরদেহ প্রদিক্ষণ শেষে তাকে সমাহিত করা হয়।
২০১২ সালের ৫ই অক্টোবর বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক নিবন্ধে বায়াফ্রার স্বাধীনতার আন্দোলনে আচিবি কি ভূমিকা পালন করেছিলেন সে বিষয়ে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় একটি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বায়াফ্রার যুদ্ধকে অজানা গল্প প্রকাশে আচিবির সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর কেউ নেই। ১৯৬৮ সালে ট্রানজিশন ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার এবং বায়াফ্রার কবিতা নিয়ে একটি বই ব্যতিরেকে নাইজেরিয়ার সব থেকে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক আচিবি নীরবতা রক্ষা করেছেন। তবে, ৮১ বছর বয়স্ক আই আচিবি চূড়ান্তভাবে তিনি তার নতুন স্মৃতি কথা ‘দেয়ার ওয়াজে কান্ট্রি’ বইয়ে প্রথমবারের মতো সেই যুদ্ধ বা তার সম্পর্কে স্মৃতিগাঁথা প্রকাশ করেছেন। আচিবির নিজের জীবনের স্মৃতিকথা আর নাইজেরিয়ার গোড়ার দিকের কথা মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বেশি আচিবির ডাক নাম ছিল ডিকশনারি। ইকব ছাত্রদের মধ্যে তাকে মনে করা হতো লাকি জেনারেশনের বরপুত্র।
(চলবে, পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
অনাগত প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন একটি ব্লু-প্রিন্ট। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কেন্ট তাকে একটি সম্মানসূচক ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ওই উৎসবে প্রফেসর রবার্ট গিবসন বলেছিলেন এই নাইজেরিও লেখক আফ্রিকান তরুণ লেখকদের কাছে একজন চিরকালীন গুরু হিসেবে নন্দিত হবেন। তাদের কাছে তিনি হয়ে থাকবেন অনুপ্রেরণার উৎস। এমনকি আফ্রিকার বাইরে তার প্রভাব ভালোভাবে অনুভূত হবে।
ঔপন্যাসিক মার্গারেট আতউত তাকে একজন জাদুকারী লেখক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মার্গারেটের কথায় আচিবি বিংশ শতাব্দীর আধুনিক লেখক। কবি মায়া আঙ্গুলুর মতে থিংস ফল এপার্ট এমন একটি বই যেখানে ‘সকল বয়সের পাঠক একটি নাইজেরিও মহাসড়কের পাশে তাদের পিতা-মাতা ভাই বন্ধুদের খুঁজে পাবেন’ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেলসন মেন্ডেলা কারাগারে নিঃসঙ্গ জীবনে আচিবিকে তিনি এমন একজন লেখক হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন যা নেলসন মেন্ডেলার ভাষায় ‘যার সান্নিধ্যে কারাগারের দেয়াল ভুপাতিত হয়েছে এবং তার সাহিত্য কর্ম থিংস ফল অ্যাপার্ট বর্ণবাদের অবসানে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে তাকে উৎসাহ যুগিয়েছে।’
অপর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী টনি মোরিসন উল্লেখ করেছেন যে, তার সাহিত্যকর্ম তাকে লেখকে রূপান্তরিত করেছে এবং আফ্রিকান সাহিত্যের প্রতি তাকে প্রেমানুরাগী করেছে। আচিবি তার সাহিত্যকর্মের জন্য ডারমত কলেজ, হার্ভার্ড এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ত্রিশটিরও বেশি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে কমনওয়েরথ পোয়েট্রি প্রাইজ, আমেরিকান এডাডেমি আর্ট অ্যান্ড লিটারেচার অনারশিপ (১৯৮২), আমেরিকান একাডেমি অফ আর্ট অফ সাইন্সেস ফোরাম ওয়ানরারি মেম্বর, একডেমিক কাজের জন্য সর্বোচ্চ নাইজেরিও খেতাব দি নাইজেরিয়ান ন্যাশনাল অর্ডার অফ মেরিট, পিস প্রাইজ অফ জার্মান বুক ট্রেড, দি ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ (২০০৭) এবং ২০১০ সালে ডরোর্থি লিলিয়ান গিস প্রাইজ, ১৯৯৯ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ড ইউএনএফফির গুডউইল এম্বাসেডার নির্বাচিত হয়েছেন। আচিবি ২০০৪ ও ২০১১ সালে দুবার নাইজেরিয়ান অর্ডার কমান্ডার অফ দ্যা ফেডারেল রিপাবলিক খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ‘তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন আমি আমার নিজের রাজ্য এনামরা নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা দেখেছি যেখানে একটি ক্ষুদ্র বিশ্বাসঘাতকের দল প্রকাশ্যে জাহির করে বেড়ায় যে ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। দৃশ্যত যাদেরকে মনে হয় তারা আমার মাতৃভূমিকে দেউলিয়া এবং আইনশৃঙ্খলাবিহীন নৈরাজ্য ভূমিতে পরিণত করতে চায়। আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষমতা লোভী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ। বিশেষ করে এই ক্ষমতা লোভীদের সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপতির যদি যোগসাযোশ না থেকে থাকে তিনি যেভাবে নীরবতা পালন করছেন তাতে আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।’
আচিবির সাহিত্য পর্বের পাণ্ডিত্যপূর্ণ অর্জন এবং তার বৈশ্বিক গুরুত্বের শর্তেও তিনি কখনো নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হননি। যা অনেক বোদ্ধাদের মতে তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ওলে সোয়েনকা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন তিনি তখন প্রথম আফ্রিকান নোবেল বিজয়ী হিসেবে সাইজেরি জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পিছিয়ে থাকেননি। বরং তিনি সোয়েনকাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলেছেন যেকোনো পুরস্কার লাভের জন্য সোয়েনকা অধিক যোগ্যতর। ১৯৮৮ সালে কোয়ালিটি উইকলি পত্রিকার একজন রিপোর্টার তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কখনো নোবেল পুরস্কার জয়লাভ না করার প্রতিক্রিয়া কেমন। তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন এ বিষয়ে আমার জবাব হলো নোবেল পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একটি ইউরোপীয় পুরস্কার এটি কোনো নাইজেরিও পুরস্কার নয়। এটি হেবি ওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ নয়। নাইজেরিওরা ভাবতে পারে এই লোকটি বুঝি নকট আউট হয়েছেন। আসলে বিষয়টি তেমনকিছু নয়। ২০১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর নাইজেরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুগল একটি ডুডল প্রকাশ করেছিল।
চিনুয়া আচিবির জন্ম ১৬ই নভেম্বর ১৯৩০ সালে। তিনি একজন নাইজেরিও উপন্যাসিক, কবি, অধ্যাপক এবং সমালোচক। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলিয় এ্যাডামরা অঙ্গরাজ্যের ইকব শহরে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। জাতিগত সংখ্যালঘু ইকব মানুষেরা ক্যামেরুন ও গিনিতে বসবাস করেন। তাদের ধর্ম প্রাথমিকভাবে খ্রিষ্ট হলেও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক ইকব মানুষদেরও নিজেস্ব ধর্ম রয়েছে। তাদের মধ্যে আবার সংখ্যালঘু হিসেবে কিছু মুসলমানও রয়েছে। তাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একটি তুলনামূলক উল্লেখ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক দিনগুলোতে হরহামেশা বায়াফ্রা শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিল। ১৯৬৬ এবং ১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলিয় জনগোষ্ঠী এবং ইকব অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ১৯৯৬৬ সালের ২৯শে জুলাই নাইজেরিও সশস্ত্র বাহিনীর একটি বিপদগামী অংশ নাইজেরিও সেনা প্রধান জেনারেল জনসনকে হত্যা করেছিল এবং সামরিক সরকার এবং বিদ্রোহী আঞ্চলিক সরকারের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে প্রতিবেশী ঘানায় চলমান শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হয়েছিল। এর পরিণতিতে পূর্বাঞ্চলিও জনগণ মূল ভূ-খ- থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং কার্যত ১৯৬৭ সালের ৩০শে মে বায়াফ্রার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। লাল সবুজে খচিত তাদের পতাকা ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রিপাবলিক ও বায়াফ্রা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত জেনারেল এমেকা বায়াফ্রার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল এবং নতুন প্রজাতন্ত্রের তিনিই রাষ্ট্র প্রধান হয়েছিলেন। এরপর শুরু হয়েছিল গৃহযুদ্ধ। ১৯৬৭ সালের ৬ই জুলাই থেকে ১৯৭০ সালের ১৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত নাইজেরিয়ান-রায়াফ্রান যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পূর্ব নাইজেরিয়ান জনগণ পরাজিত হয়েছিলেন। এর ফলে তাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। এই গৃহযুদ্ধে পূর্ব নাইজেরিয়ার লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়। এই যুদ্ধে বায়াফ্রার জনগণ বাংলাদেশের মানুষের মতই জাঁ পল সাত্রে এবং জন লেননের মতো ব্যক্তির সমর্থন পেয়েছিলেন। জন লেনন ওই যুদ্ধে বৃটিশ ভূমিকার প্রতিবাদে তাকে দেয়া অর্ডার অফ দ্য বৃটিশ এমপায়ার (এমবিই) পরিত্যাগ করেছিলেন। বায়াফ্রার জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম অবশ্য আজও শেষ হয়নি। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে বায়াফ্রার প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল এমেকা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে নাইজরিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। জেনারেল এমেকা ২০১১ সালে ৭৮ বছর বয়সে বৃটেনে মারা যান। তবে, লক্ষণীয় যে নাইজেরিয়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীন বায়াফ্রা রাষ্ট্র গঠন করা সত্ত্বেও নাইজেরিও সশস্ত্র বাহিনী পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তার অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষ করেছে। দেশটির পাঁচটি পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে তার মরদেহ প্রদিক্ষণ শেষে তাকে সমাহিত করা হয়।
২০১২ সালের ৫ই অক্টোবর বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক নিবন্ধে বায়াফ্রার স্বাধীনতার আন্দোলনে আচিবি কি ভূমিকা পালন করেছিলেন সে বিষয়ে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় একটি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বায়াফ্রার যুদ্ধকে অজানা গল্প প্রকাশে আচিবির সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর কেউ নেই। ১৯৬৮ সালে ট্রানজিশন ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার এবং বায়াফ্রার কবিতা নিয়ে একটি বই ব্যতিরেকে নাইজেরিয়ার সব থেকে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক আচিবি নীরবতা রক্ষা করেছেন। তবে, ৮১ বছর বয়স্ক আই আচিবি চূড়ান্তভাবে তিনি তার নতুন স্মৃতি কথা ‘দেয়ার ওয়াজে কান্ট্রি’ বইয়ে প্রথমবারের মতো সেই যুদ্ধ বা তার সম্পর্কে স্মৃতিগাঁথা প্রকাশ করেছেন। আচিবির নিজের জীবনের স্মৃতিকথা আর নাইজেরিয়ার গোড়ার দিকের কথা মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বেশি আচিবির ডাক নাম ছিল ডিকশনারি। ইকব ছাত্রদের মধ্যে তাকে মনে করা হতো লাকি জেনারেশনের বরপুত্র।
(চলবে, পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)