শেষের পাতা

নি র্বা চ নী হা ল চা ল (মানিকগঞ্জ-২)

মুখোমুখি আওয়ামী লীগ জাপা, চ্যালেঞ্জে বিএনপি

রিপন আনসারী/আতাউর রহমান, মানিকগঞ্জ থেকে

২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

পদ্মার ভাঙনকবলিত হরিরামপুর, রাজধানী ঢাকার সীমানা ঘেষা সিংগাইর এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-২ আসন। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। পথে- ঘাটে শোভা পাচ্ছে ব্যানার-পোস্টার। এখানে বড় দলগুলোর ভেতর রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুলের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। আর এখানে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতাসহ তিনজন। এছাড়া জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের ভেতর মহাজোট প্রার্থী নিয়ে চলছে টানাটানি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন সাবেক একজন শিক্ষা উপমন্ত্রী।

২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত মানিকগঞ্জে মোট আসন ছিল চারটি। এর মধ্যে সিংগাইর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে মানিকগঞ্জ-৪ আসন এবং হরিরামপুর ও শিবালয় উপজেলা নিয়ে ছিল মানিকগঞ্জ-২ আসন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আগের সীমানা অনুযায়ী প্রত্যেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। সাবেক মানিকগঞ্জ-২ আসনের চারবারের সংসদ ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত বিএনপি নেতা হারুনার রশিদ খান মুন্নু। আর সাবেক মানিকগঞ্জ-৪ আসনের চার বারের সংসদ সদস্য ছিলেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শামসুল ইসলাম খান নয়া মিয়া। এই দুই নেতার কেউ এখন জীবিত নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করায় জেলার একটি আসন কমিয়ে তিনটি করা হয়। সিংগাইর উপজেলা, মানিকগঞ্জ সদরের তিনটি ইউনিয়ন ও হরিরামপুর উপজেলা নিয়ে ২০০৮ সালে গঠিত হয় মানিকগঞ্জ-২ আসন। এতে মানিকগঞ্জ-৪ আসনটি মুছে যায় নির্বাচন কমিশনের খাতা থেকে।

 ২০০৮ সালের নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনের চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত বিএনপি নেতা হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা। তার সঙ্গে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এসএম আবদুল মান্নান। বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি এবং প্রার্থী হিসেবে আফরোজা খান রিতার ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও সারা দেশের প্রেক্ষাপটে মহাজোট প্রার্থী জয় পায়। আফরোজা খান রিতা আগামী নির্বাচনেও এ আসনসহ মানিকগঞ্জের তিনটি আসনেই মনোনয়ন চাইবেন। মানিকগঞ্জ-২ আসনের বিএনপি নেতৃবৃন্দ বেশ জোরালো ভাবেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে আফরোজা খান রিতাকেই চাচ্ছেন। এছাড়া মনোনয়ন চাইবেন সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শামসুল ইসলাম খান নয়া মিয়ার পুত্র জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম খান শান্ত ও সিংগাইর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবিদুর রহমান রোমান। তবে আফরোজা খান রিতা কিংবা মঈনুল ইসলাম খান শান্তর মধ্যে যে কেউ এখানে মনোনয়ন পাবেন এটা স্পষ্ট।

মানিকগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি মনোনয়ন প্রত্যাশী সিংগাইর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবিদুর রহমান রোমান বলেন, আগামী নির্বাচন আমাদের দলের জন্য চ্যালেঞ্জের নির্বাচন। তাই যেনো-তেনো প্রার্থী দিয়ে এখানে নির্বাচন করালে জয় সহজ হবে না। আমি প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছি ঠিকই। কিন্তু দলীয় প্রার্থী হিসেবে শতভাগ ফিট হচ্ছেন জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা। কারণ তার গ্রহণ যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতা আর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে দলের ভেতর কোনো ধরনের বিতর্ক থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে আমি তার পক্ষে কাজ করবো।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বলেন, আমার বাবা হারুনার রশিদ খান মুন্নু ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে টানা চার বার বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালে তিনি একসঙ্গে মানিকগঞ্জ-২ ও মানিকগঞ্জ-৩ আসনেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে বিশাল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। আমার বাবা শুধু আমার পরিবারের অহঙ্কারই নয় তিনি গোটা মানিকগঞ্জবাসীর ভালোবাসার এক নিদর্শন। গোটা মানিকগঞ্জের মানুষ তাকে ভালো বাসতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির সঙ্গে মিশে ছিলেন। কখনো বেঈমানী করেননি। সেই বাবার রক্ত আমার শরীরে বইছে। আমি আমার বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে এসেছি। বিগত দিন থেকে অদ্যাবধি দলের এতো দুঃসময় গেছে, তারপরও পিছু হটিনি। দলের দুঃসময়ে অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন সামনে নির্বাচন তাই বসন্তের কোকিলের মতো অনেকেই সামনে আসার চেষ্টা করবে।

২০০৮ সালে মানিকগঞ্জ-২ আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে দেখা দেয় নানা নাটকীয়তা। সে সময় দুই দফা মনোনয়ন পরিবর্তন করা হয় আওয়ামী লীগে। প্রথম মনোনয়ন পান সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা শামসুদ্দিন আহমেদ। মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই তাকে বাদ দিয়ে আবার প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুলের নাম। শেষমেশ আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীই বাদ পড়ে যায়। পরে মহাজোটের প্রার্থী করা হয় জেলা জার্তীয় পাটির সভাপতি এসএম আবদুল মান্নানকে। এসএম মান্নান জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ার আগে বিএনপি ঘরোনা হয়ে বেশ কিছুদিন গণসংযোগ চালিয়েছিলেন। বিএনপি থেকে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের হাত ধরে জাপায় যোগ দেন।

এরপর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় এই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এর আগে মমতাজ বেগম ছিলেন সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ।

৫ই জানুয়ারিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে তার সামনে রয়েছে বড় দুটি বাধা। প্রথম বাধা হচ্ছে নিজ দলের শক্তিশালী সম্ভাব্য প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক প্রাক্তন ফুটবলার দেয়ার শফিউল আরেফিন টুটুল। অপর প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন জাতীয় পার্টি। কারণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হয়ে এই আসন থেকে জয়লাভ করেছেন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এসএম আবদুল মান্নান। নিজ ঘরের শক্তিশালী প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে যদি জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকে তাহলে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে উঠতে পারে এই আসনে মহাজোট প্রার্থী।

এছাড়া এখানে আওয়ামী লীগের ভেতর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেশ জোরালো। এর জের ধরে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে নেমেছেন কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক প্রাক্তন ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুলের মধ্যে বিরাজ করছে দা-কুমড়ো সম্পর্ক। এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও দুই নেতার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান করছেন। আবার এই দুই নেতার বাইরেও রয়েছেন আরো কয়েক নেতা। তারা পৃথক পৃথক ভাবেও দলীয় কর্মকাণ্ড চালানোর পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে গণসংযোগে মাঠে নেমেছেন। এদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও হাটিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মনির হোসাইন জোরালো ভাবেই নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শামসুদ্দীন আহম্মেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলী জিলকদ আহমেদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আবদুস সালাম চৌধুরীর নামও শোনা যাচ্ছে মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, আমাদের নির্বাচনী এলাকাটি ঢাকার অতি কাছের। শিক্ষা-দিক্ষা,ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার যে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তা আমরা করতে পারিনি। এক কথায় এই এলাকাটি এতদিন ঢাকার একটি অংশ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেই জায়গাটায় নিয়ে যেতে হবে। যদি দলীয় মনোনয়ন পাই এবং নির্বাচিত হতে পারি সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ কবরো। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছি দেখা যাক সময়ই বলে দেবে।

সাবেক এমপি সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে কথা দিয়েছেন। তিনি যদি ভুলে না যান তাহলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবো এ বিশ্বাস আমার আছে। নির্বাচনকে সমানে রেখে এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি আবদুল মান্নান বলেন, মহাজোটে থাকার কারণে দলের সিদ্ধান্তে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে আগামী নির্বাচনের জন্য আমি নিজ এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। মহাজোট হয়ে নির্বাচন হলে এই আসনে আমার মনোনয়ন নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করি।
এদিকে এক সময়কার জাতীয় পার্টির জামানায় শিক্ষা উপমন্ত্রী গোলাম ছারোয়ার মিলনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সিংগাইরে। তিনি আপাতত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে থাকলেও বড় কোনো দলের সিগনালের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।

আগামীকাল: মুন্সীগঞ্জ-১
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status