বিশ্বজমিন

খালেদার বৃটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইল কে!

মানবজমিন ডেস্ক

২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ১০:১০ পূর্বাহ্ন

বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে সম্মতি জানিয়েছেন বৃটেনের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী লর্ড অ্যালেক্স কার্লাইল। মঙ্গলবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার ৩৬টি মামলাতেই তার আইনজীবী দলকে পরামর্শ দেবেন তিনি। প্রয়োজন পড়লে আসবেন বাংলাদেশেও। তিনি আরও বলেন, কয়েক দশক ধরে বৃটেনের রাজনীতি ও আইন পেশায় জড়িত লর্ড কার্লাইল।
ফৌজদারি মামলা লড়ার দীর্ঘ ও ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে তার। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। খালেদা জিয়ার মামলাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তার প্রভাব ও পরিচিতি সহায়ক হবে বলে মনে করে বিএনপি। বিএনপি’র ঘোষণার পর, কার্লাইল এক প্রেস বিবৃতিতে খালেদার বিচার প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
লর্ড অ্যালেক্স কার্লাইল সম্পর্কে মানবজমিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেশ কিছু তথ্য। অ্যালেক্সান্ডার চার্লস কার্লাইল, সংক্ষেপে অ্যালেক্স কার্লাইল বৃটেনের আইনসভার উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য। তিনি বৃটেনের খ্যাতিমান ও শীর্ষস্থানীয় আইন বিশারদদের একজন।
২০১২ সালের আগস্টে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ইকুয়েডর দূতাবাস আশ্রয় নেওয়ার পর বৃটেন দূতাবাসে প্রবেশ করে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বিবেচনা করেছিল। কিন্তু বেশ কয়েকজন বৃটিশ আইনজীবী দূতাবাসে প্রবেশ করাকে বেআইনি হবে বলে মত দেন। তাদের মধ্যে লর্ড কার্লাইলও ছিলেন।
আমেরিকার প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যম এনপিআর সেই সময় লিখেছিল, ‘কিছু বিশেষজ্ঞ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বৃটিশ আইন অনুযায়ী কাজ করলে [অর্থাৎ দূতাবাসে প্রবেশ করে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করলে], তা বেআইনি হবে। কারণ তাতে দূতাবাসের কূটনৈতিক সুরক্ষা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হবে। এই বিশেষজ্ঞদের একজন হলেন লর্ড অ্যালেক্স কার্লাইল, যিনি বৃটেনের শীর্ষ আইনি বিশেষজ্ঞদের একজন।’ এ সময় এনপিআর অ্যালেক্স কার্লাইলের একটি মন্তব্য প্রচার করে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমার মতে, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা চাইলেই ইকুয়েডরের দূতাবাসে হানা দিতে পারি না। বৃটিশ কর্তৃপক্ষের প্রবেশাধিকার থেকে দূতাবাস মুক্ত। তাই ধৈর্য্য ধরা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। শেষ অবদি তিনি যখন বের হবেন, তাকে গ্রেপ্তার করা হবে ও সুইডেনে ফেরত পাঠানো হবে।’
বৃটেনে পোলিশ অভিবাসী পিতামাতার সন্তান অ্যালেক্স কার্লাইল বড় হয়েছেন নর্থ ওয়েলস ও ল্যাঙ্কাশায়ারে। পড়াশুনা করেছেন ইপসম কলেজ ও লন্ডনের কিং’স কলেজে। কিং’স কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি আইন নিয়ে ¯œাতক সম্পন্ন করেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি কিউসি হন।  
তিনি প্রিন্সেস ডায়ানার খানসামা পল বারেলের পক্ষে লড়েছিলেন। বারেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ডায়ানার এস্টেটের কয়েক মিলিয়ন ডলারের সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। কিন্তু পল বারেল নির্দোষ সাব্যস্ত হন।
২০০১ সালে, বৃটেন সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যে আইন প্রনয়ণ করে, তার স্বাধীন পর্যবেক্ষক (ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিভিউয়ার) হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি। পদাধিকার বলে তিনি বৃটেনের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কর্মকান্ড সম্পর্কে সরকারের স্বাধীন উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্বরত ছিলেন।
এ সময় বৃটিশ সরকারের বিতর্কিত ‘কন্ট্রোল অর্ডার’ প্রনয়ণে তার ভূমিকা ছিল। পরে তিনি কথিত ‘¯œুপার্স চার্টার’ প্রনয়নেও ভূমিকা রাখেন। এর মাধ্যমে গণহারে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহকে বৈধতা দেওয়া হয়। তার নিজ দল লিবারেল ডেমোক্রেট এর তীব্র বিরোধীতা করেছিল। পরে তাকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কিত স্বাধীন পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
২০১২ সালে কার্লাইলকে ‘কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য বৃটিশ এমপায়ার’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের বছর দীর্ঘদিনের স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত লিবারেল ডেমোক্রেট দল থেকে মন্টগোমারিশায়ারের এমপি ছিলেন অ্যালেক্স কার্লাইল। তখন তিনি ছিলেন ওয়েলশ থেকে নির্বাচিত একমাত্র লিবারেল দলীয় এমপি। পরে তিনি ওয়েলশ লিবারেল ডেমোক্রেট দলের প্রধান নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি বৃটেনের হাইকোর্টের ডেপুটি বিচারক ছিলেন। একটি কম্পিটিশন অ্যাপিলস ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমানে এসসি স্ট্রেটজি লিমিটেড নামে একটি কৌশলগত ও রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক ও সহ-পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠানের আরেক প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক হলেন স্যার জন স্কারলেট, যিনি বৃটেনের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬-এর সাবেক প্রধান। এই প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ও কৌশলগত ইস্যুতে গ্রাহকদেরকে গোপনীয় সেবা দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের পরিচয় তেমন জানা যায় না। একমাত্র জ্ঞাত গ্রাহক হলো কাতারের স্বার্বভৌম জাতীয় তহবিল কর্তৃপক্ষ।  
২০১৪ সালে ইরানি ভিন্নমতালম্বী রাজনীতিক মরিয়াম রাজাভির ওপর বৃটিশ সরকারের আরোপিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পক্ষে সরব ছিলেন কার্লাইল। তবে শেষ অবদি সুপ্রিম কোর্ট সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দেয়।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী বিল তথা ‘¯œুপার্স চার্টার’-এ সংশোধনী আনতে হাউজ অব লর্ডের যেই চার সদস্য জোর চেষ্টা চালান, তার একজন ছিলেন কার্লাইল। অপর তিন সদস্য ছিলেন কনজারভেটিভ দলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লর্ড কিং, লেবার দলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লর্ড ওয়েস্ট ও মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার লর্ড ব্লেয়ার। ওই সংশোধনীতে গণ-নজরদারি বিস্তৃত করতে বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত ছিল। বৃটেনের লেবার পার্টি তখন এর তীব্র বিরোধীতা করেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃটেনের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে সরব ছিলেন কার্লাইল। ২০১৩ সালের অক্টোবরে তিনি মত দেন যে, এডওয়ার্ড ¯েœাডেন গণ-নজরদারি বিষয়ক যেসব গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করেছেন, তা ফৌজদারি অপরাধের সামিল।  
২০১৭ সালে নজরদারি ও নাগরিক স্বাধীনতা (সিভিল লিবার্টিজ) ইস্যুতে নিজের লিবারেল ডেমোক্রেট দলের সঙ্গে মতদ্বৈততার জেরে তিনি পদত্যাগ করেন। তখন তিনি ৭০ বছর আগে চার্চ অব ইংল্যান্ড কীভাবে শিশু যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সামাল দিয়েছিল, তা নিয়ে শীর্ষ স্বাধীন পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে লর্ড কার্লাইলের নাম এই প্রথম আসে নি। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে তিনি আপত্তি উত্থাপন করেন। ২০১৩ সালে বৃটেনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদনে তাকে উদ্ধৃত করা হয়। এ সময় তিনি ট্রাইব্যুনাল নিয়ে তার আপত্তি তুলে ধরেন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সম্পাদক বরাবর লেখা এক চিঠিতে তিনি সহ চারজন আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানান।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদেরকে হাউজ অব লর্ডসের একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানান তিনি। তবে সেটি হাউজ অব লর্ডসের আয়োজিত সেমিনার ছিল না। ওই সেমিনারে যোগদানে প্রাথমিক সম্মতি দিলেও, পরে উপস্থিত হয়নি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা গওহর রিজভি ও মশিউর রহমান।
(সূত্র: গার্ডিয়ান, বিবিসি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, টাইমস অব ইসরাইল, ডেইলি পোস্ট, উইকিপিডিয়া।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status