অনলাইন

তারা জীবনের জন্যে লড়ে, আর আমরা তাদের জন্য

লিন হাশেম

২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

কেমন লাগে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে? অসুস্থ সন্তানকে খাদ্য এবং চিকিৎসা দিতে না পারলে। দূষিত নোংরা পানি দিয়ে খাবার ধুতে হলে। একের পর এক নির্ঘুম রাত বোমাবর্ষণের ভেতর জীবনের হুমকি নিয়ে কাটাতে। নিজের ভালবাসার শহরকে ধংসস্তুপে পরিণত হতে দেখতে। কেমন লাগে? প্রতিদিন নিজেকে এই প্রশ্নটি না করে আমি॥ পারি না। যেহেতু সিরিয়ার পূর্ব ঘৌটায় অবস্থান করার কারণে প্রতিদিনই আমাকে সেখানে অবরুদ্ধ থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, আমি প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে পারি না। আসলে কেমন লাগে- প্রতিটা দিন নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জীবনের হুমকি নিয়ে বাঁচতে?

সিরিয়ার পূর্ব ঘৌটার প্রাত্যহিক বাস্তবতা এমনই। এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ। তবে তারা যে সেখানে স্বেচ্ছায় বসবাস করছে- তা নয়। ২০১২ সাল থেকে সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর অবরোধে আটকে আছে এসব মানুষ। সেখানে চিকিৎসা, খাদ্য, পানি ও ওষুধপত্রের তীব্র সঙ্কট। তার ওপরে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার সঙ্গে মিলে অবরোধ আরো জোরদার করে সিরিয়া। বেড়ে যায় তা-বের পরিমাণ। ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক স্থাপনা এবং নাগরিকদের বোমাবর্ষণ এবং হামলার লক্ষবস্তুতে পরিণত করা হয়। এমনকি হাসপাতাল বাজারগুলোতেও হামলা চালানো হতে থাকে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কম মরাকান্না কাঁদে নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি এক মাসের যুদ্ধবিরতির আবেদন করে, যাতে করে অঞ্চলটিতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়া যায়। এতে সম্মতি দেখালেও বাস্তবে কিন্তু হামলা ও বোমাবর্ষণ থামায় নি সিরিয়া। ফলে বাধ্য হয়েই ৫ই মার্চে ত্রাণবাহী গাড়িবহর আংশিক ত্রাণ বিতরণ করে পূর্ব ঘৌটা ত্যাগে বাধ্য হয়।
সিরিয়ায় নৃশংসতা চলছে সাত বছর ধরে। সাত বছর ধরে দেশটির আলেপ্পো, হোমস, রাকা, ইদলিব ও আফরিনসহ অন্যান্য শহরে চলছে মৃত্যু, ভয়, কষ্ট এবং ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। এই সাত বছরের মধ্যে ছয় বছরই পূর্ব ঘৌটার অধিবাসীরা বেআইনিভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। এর ভেতরেই তারা বেঁচে আছেন।

যখন আমি এসব ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, রাগান্বিত কিন্তু নির্ভীক মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলি, তাদের ভেতরকার লড়াকু জীবনীশক্তি দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাই। পূর্ব ঘৌটা যদিও একটি মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে, এটি কিন্তু বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্খার প্রতীকেও পরিণত হয়েছে। সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও হাল না ছেড়ে মানুষ কিভাবে বাঁচার চেষ্টা করে- তার মূর্ত প্রতীক পূর্ব ঘৌটার অধিবাসীগণ। এই অমানবিক পরিস্থিতি পৃথিবীকে চরম লজ্জার সামনে দাড় করিয়ে দেয়। এই নারকীয় অবস্থার মধ্যেও এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অব্যাহত লড়াই দেখে আমাদের চেতনা জাগ্রত হওয়া উচিত। প্রতিবাদ জানানো উচিত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অথচ, সাত বছর ধরেই এই নারকীয়তা চলে আসছে! অবস্থাদৃষ্টে সিরিয়ার সঙ্কট আমাদের আশা, ভরসা কিংবা প্রার্থনার উর্ধ্বে চলে গেছে। এভাবে কি চলতে থাকবে অনির্দিষ্টকাল? না। তা হতে পারে না। আমাদের বিবেকের ঘুম ভেঙে জাগতে হবে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে অব্যাহতভাবে দাবি জানাতে হবে এই নারকীয়তা বন্ধের। জরুরীভিত্তিতে সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ করতে হবে। উঠিয়ে নিতে হবে পূর্ব ঘৌটায় আরোপিত অবরোধ। এই দাবিতে গলা মেলাতে হবে সবার। মনে রাখতে হবে, পূর্ব ঘৌটার অধিবাসীরা যেমন প্রতিনিয়ত জীবনের জন্যে লড়ছে; আমাদের লড়তে হবে তাদের জন্যে।

(লিন হাশিম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিরিয়া ক্যাম্পেইনার। মানবাধিকার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন নাজমুস সাদাত পারভেজ)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status