বাংলারজমিন

বুড়িচংয়ের ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল-নালা

মো. মোসলেহ উদ্দিন, বুড়িচং (কুমিল্লা) থেকে

২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৮:০৭ পূর্বাহ্ন

কুমিল্লার জেলার বুড়িচং উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৭ হাজার ১৮১ জন কৃষক কৃষি কাজের মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এ অঞ্চলের প্রধান কৃষিপণ্য ধান। ধান উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে অনেক কৃষক তাদের পরিবার-পরিজনের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে। বিশেষ করে বোরো ফসলকে কেন্দ্র করে সারা বছরের খাদ্য চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে থাকে। বন্যা ও বৃষ্টির কারণে বছরের অন্যান্য ফসলগুলোর তুলনায় এ অঞ্চলের মানুষ বোরো ধান রোপণ করে বেশি। কিন্তু বর্তমানে উপজেলার নালা-খালগুলো দীর্ঘদিন খনন না করার ফলে পলিমাটি জমে অধিকাংশ নালা ও খাল ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া কিছু ভূমিদস্যু ড্রেজারের মাধ্যমে মাটি কেটে খালগুলো ভরাট করে ঘরবাড়ি ও দোকান-পাট নির্মাণ করার প্রতিযোগিতা নেমেছে। ফলে দিনে দিনে পানি নিষ্কাশনের খালগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং উজান থেকে ভারতের পানি নেমে এসে বোরে ফসলের মাঠগুলো পানির নিচে চলে যায়। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। তা ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট ছোট খাল ও নালাগুলোর অস্তিত্ব নেই। সড়কের উপরে থাকা কালভার্ট ও ব্রিজগুলো দেখতে পাওয়া যায়। ব্রিজ ও কালভাটগুলো খাল ও নালার ওপর অবস্থান করা শেষ চিহ্ন হিসেবে টিকে আছে। যা দেখলে বুঝা যায় এখান দিয়ে এক সময় খাল ও নালা ছিল। যা দিয়ে পানি প্রবাহিত হতো। কিন্তু এখন এগুলো স্মৃতি হয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের তদারকির অভাবে ক্রমান্বয়ে উপজেলার খাল ও নালাগুলো ভরাট হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
এই খাল ও নালাগুলো প্রথম খননের পরে আবার কবে খনন করা হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। যদিও মাঝে মধ্যে খাল খননের কোন কর্মসূচি বা কোনো প্রকল্প অনুমোদন করা হয়, তবে তা থাকে কাগজে কলমে। বাস্তবে তা কখনো আলোর মুখ দেখতে পায় না।
বুড়িচং উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় ফসলের মাঠের নাম হলো পয়াতের জলা। যার মধ্যে বুড়িচং ও আদর্শ সদর উপজেলার কয়েক হাজার কৃষক ধান চাষ করে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মেটায়। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে এই মাঠের পানি নিঃষ্কাশনের জন্য চারদিকে যে খালগুলো রয়েছে তা ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং কোথাও কোথাও ভূমিদস্যুরা ঘ-বাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ করার কারণে সামান্য বৃষ্টি হলে বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এ অঞ্চলের কৃষকের কপালে দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে। প্রতি বছর বর্ষার পানিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ধান চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বুড়িচং উপজেলায় প্রায় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭০৫ জন লোকের বসবাস। এর মধ্যে ৪৭ হাজার ১৮১টি পরিবারের লোকজন সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এবছর ৯ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে এবং ৩৬ হাজার ৫৮৭ টন চাল উৎপাদন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে খালগুলো বৃষ্টির পানি নিঃষ্কাশনের জন্য যে নালা ও খাল রয়েছে সেগুলো খনন না করা হলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের জরইন গ্রামের আইপিএস কৃষক ক্লাবের সভাপতি মো. আবদুল জলিল ভুঞা জানান, তিনি বিগত ১০ বছর ধরে খালগুলোকে অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে উদ্ধারে জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তিনি বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। তিনি জানান, জরইন গ্রামের বিএস ৭২০ ও ৭১৮ দাগের খাস ভূমি ও খালের জায়গা একই গ্রামের জামাল হোসেন, হাজী মতিউর রহমান, সিরাজুল ইসলাম পেশকার, আঃ সামাদ, মোসলেম উদ্দিন ও রফিকুল ইসলাম ভরাট করে দীর্ঘদিন দখল করে রেখেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার সদর ইউনিয়নের যদুপুর গ্রামের হাফিজিয়া মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন খালটি ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করে ফেলেছে। বর্তমানে খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুড়িচং বাজারের পশ্চিম পার্শ্বের খালটিও ভরাট হয়ে প্রায় নালায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া রাজাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর পশ্চিম পাড়া এলাকায় খাল ভরাট করে জুজু মিয়া মেম্বার নামে একটি সড়ক করা হয়েছে। ষোলনল ইউনিয়নের খাড়াতাইয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন খালটির ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে অপর দিকে আগানগর দীঘিচর এলাকার খালটিও প্রায় ভরাট হয়ে গেছে।
বুড়িচং উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ছোট বড় প্রায় ২০৩টি খাল রয়েছে। তার মধ্যে রাজাপুর ইউনিয়নের ১১০টি, বাকশীমুল ইউনিয়নের ঘুংঘুর, কাকদী ও পাগলীসহ ৩টি, বুড়িচং সদর ইউনিয়নে ২৬টি, পীরযাত্রাপুর ইউনিয়নের ৩টি, ষোলনল ইউনিয়নের ৫টি, ময়নামতি ইউনিয়নে ৯টি, ভারেল্লা ইউনিয়নে ১৬টি এবং মোকাম ইউনিয়নে মৌজাভিত্তিক ছোট-বড় প্রায় ৩০টি।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইমরুল হাসান বলেন, উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় বুড়িচং সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম এবং ষোলনল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করার পর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমি,কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করি। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলীর কার্যালয় বিএডিসি ক্ষুদ্র সেচ ইফনিট নামে বুড়িচং উপজেলা সদরে একটি কার্যালয় থাকলেও তা সব সময় তালাবদ্ধ থাকে। এই কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে কি নেই, তা কেউ বলতে পারে না। শুধু সাইনবোর্ডটাই দেখতে পাওয়া যায়। ওই কার্যালয়ের দায়িত্বশীল না থাকায় খাল ও নালাগুলো খননের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status