দেশ বিদেশ

সিলেট-আখাউড়া রেলপথে সাড়ে ৪ মাসে ৯ দুর্ঘটনা

এম ইদ্রিস আলী, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে

২০ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ট্রেন দুর্ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। ১৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ রেল লাইনের বেশিরভাগ ক্লিপ চুরি হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে রেলপথটি। গত সাড়ে ৪ মাসে শুধুমাত্র শ্রীমঙ্গল থেকে সিলেট অংশে ৯ বার দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে বিভিন্ন ট্রেন। এরমধ্যে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ বার। ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, জরাজীর্ণ বগি, শিডিউল বিপর্যয়, ইঞ্জিন লাইচ্যুত হওয়াসহ নানা কারণে যাত্রীসেবায় পিছিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনে নিয়মিত ক্লিপ-হুক চুরি ও সেতু-কালভার্ট সংস্কারের অভাবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ রেলপথটি।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেললাইন ও স্লিপারের সঙ্গে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক অবাধে চুরির ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে রেললাইন। এ ছাড়া রেলসেতুও কালভার্টের ৩০-৪০ বছরের পুরনো কাঠের স্লিপারের অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে।
রেলওয়ের তথ্য মতে, সিলেটের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। যাত্রীদের নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের কথা চিন্তা করে ১৯৮৭ সালে আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়। ঢাকা-সিলেট রুটে প্রতিদিন কালনী, জয়ন্তিকা, পারাবত, উপবন এক্সপ্রেস নামের ৪টি আন্তঃনগর ট্রেন ও সুরমা মেইল নামের একটি লোকাল ট্রেন চলাচল করে। সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে পাহাড়িকা, উদয়ন এক্সপ্রেস নামের ২টি আন্তঃনগর ও জালালাবাদ এক্সপ্রেস নামের একটি লোকাল ট্রেন চলাচল করে। সিলেট-আখাউড়া রুটে ডেমো ও কুশিয়ারা নামের আরো দুটি লোকাল ট্রেন চলাচল করে। রেল সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চলীয় জোনের আওতাভুক্ত রেলের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি রুটে চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিনগুলো প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো। পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলাচলের কারণে প্রায়ই ঘটছে ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা। নিয়ম অনুযায়ী ট্রেন গন্তব্যে আসার পর ইঞ্জিন তিন-চার ঘণ্টা বিশ্রামে রাখার কথা। কিন্তু ইঞ্জিনের সংকট থাকায় গন্তব্যে পৌঁছার পর অন্য ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দিতে হচ্ছে। ফলে ইঞ্জিনে বাড়তি চাপ পড়ছে এবং প্রায়ই তা বিকল হয়ে পড়ছে। তাই সময়মতো ট্রেন স্টেশন ছাড়তে কিংবা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৮ মার্চ সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন বিকাল ৩-৪০ মিনিটে মাইজগাঁও রেল ষ্টেশনে পৌঁছার পর ইঞ্জিনের বাফারের হুকের সেন্টার পিনে ফাটল দেখা দেয়। পরে ট্রেন চালক যাত্রীবাহী বগীগুলো মাইজগাঁও স্টেশনে ফেলে রেখে শুধুমাত্র ইঞ্জিন নিয়ে কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের লোকশেডে পৌঁছান। পরে লোকোসেডের প্রকৌশলীরা হুকের সেন্টার পিনের ফাটল মেরামত করে দিলে চালক ইঞ্জিন নিয়ে পুনরায় মাইজগাঁও স্টেশনে পৌঁছে যাত্রীবাহী বগিগুলো নিয়ে ২ ঘণ্টা পর ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যান। ওইদিন রাতে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন ট্রেন রাত সাড়ে ১১ূূটায় কুলাউড়ার লংলা স্টেশন অতিক্রমকালে চলন্ত অবস্থায় উক্ত ১ম শ্রেণির এক বগির চাকার স্প্রিং ভেঙে যায়। পরে চালক ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনটি পরবর্তী শমসেরনগর স্টেশনে নিয়ে যান। সেখানে বিকল বগি রখে অপর বগিগুলো নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা পর ট্রেনটি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১টার দিকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও রেলস্টেশনের আউটারস্যিগনাল এলাকায় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের ১১টি বগি নিয়ে লাইনচ্যুত হয়। এতে সিলেট-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা। অর্থ প্রতিমন্ত্রীসহ ট্রেনের হাজারও যাত্রী বড় রকমের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান। ২৩শে জানুয়ারি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাহাড়ি এলাকায় ইঞ্জিনের দুর্বলতার কারণে ভোর রাতে দু’দফা আটকা পড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর বিকল্প ইঞ্জিন আসলে ট্রেনটি সচল হয়। এতে পাহাড়ি এলাকায় যাত্রীরা চরম ভীতি ও দুর্ভোগের শিকার হন। ১লা ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে ছেড়ে আসা একটি মালবাহী ট্রেন বিকাল পৌনে ছয়টায় ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা রেলওয়ে ব্রিজের উত্তর পাড়ে একটি বগি লাইনচ্যুত হলে সিলেটের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ে। কুলাউড়া থেকে রিলিফ ট্রেন এসে লাইনচ্যুত বগিগুলো উদ্ধার করলে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।  গত বছরের ১৩ই ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী শিববাড়ি বাজার এলাকায় লাইনচ্যুত হয় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা লোকাল ট্রেন জালালাবাদ এক্সপ্রেস। সিলেট থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন গিয়ে লাইনচ্যুত ট্রেনটি উদ্ধার করলে প্রায় ৩ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচলা স্বাভাবিক হয়। ৫ই ডিসেম্বর সকাল ১১টায় দিকে মোগলাবাজার স্টেশনের ২নং প্লাটফর্মে ফের লাইনচ্যুত হয় সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ট্রেনটি উদ্ধার করা হলে চলাচল স্বাভাবিক হয়।  এর আগে গত ৩০শে নভেম্বর কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের ভাটেরা রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছে পুনরায় লাইনচ্যুত হয় জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন। টানা ৪ ঘণ্টা পর কুলাউড়া স্টেশন থেকে রিলিফ ট্রেন এসে ট্রেনটি উদ্ধার করলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ১২ই নভেম্বর বিকাল ৩টায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন সিলেটের মোগলাবাজার ট্রেশনে প্রবেশের আগ মুহূর্তে ইঞ্জিনের সঙ্গে বগিকে যুক্ত রাখা পাইপ (হোস পাইপ) খুলে যায়। এতে ইঞ্জিন থেকে বগি আলাদা হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যায় ট্রেন।  ইঞ্জিন প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে চলে যাওয়ার পর চালক বিষয়টি বুঝতে পারেন। পরে বগির সঙ্গে আবার ইঞ্জিন সংযুক্ত করে ট্রেনটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট-আখাউড়ায় সেকশন থেকে অব্যাহতভাবে চুরি হচ্ছে ক্লিপ-হুক। রেললাইনের সঙ্গে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক চুরির ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে রেললাইন। এ সেকশনের রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের ওপর জীর্ণশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বাঁশের ফালি স্থাপন করা হয়েছে। চুরি যাওয়া এসব যন্ত্রাংশ দ্রুত লাগানোর নিয়ম থাকলেও বছরের পর বছর তা লাগানো হচ্ছে না। রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের ৩০-৪০ বছরের পুরনো কাঠের স্লিপারের অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ছিটকে গেছে রেলপথের পাথর।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status