প্রথম পাতা

কোটা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

হাফিজ মুহাম্মদ

১৭ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ১০:০০ পূর্বাহ্ন

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর পারছি না। একাধিকবার ভাইভা দিয়েও চাকরি পাচ্ছি না। কোটার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে জীবন। 
মেধার মূল্য বিফলে। আমার থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েও তারা একবার ভাইভা দিয়েই চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। আমাদের আন্দোলনকারীদের মধ্যে এমনও অনেক আছেন যাদের ১৫ বার ভাইভা দিয়েও চাকরি হয়নি। অতিদ্রুত কোটা সংস্কার করা না হলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। কথাগুলো বলেছিলেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দেলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। বলেন, এ আন্দোলন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। এটা একটা যৌক্তিক আন্দোলন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পরেও একটা দেশে ৫৬ ভাগ কোটা থাকতে পারে না। এতটা বৈষম্য নিয়ে একটা দেশ চলতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে কোটা সংস্কার করে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা অহিংস আন্দোলন করে যাচ্ছি এবং আমাদের দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমাদের যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে অনেকে বিভিন্নরকম প্রপাগান্ডা চালায়। কিন্তু আমি বলতে চাই এটা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাত্রদের আন্দোলন। অধিকার রক্ষার আন্দোলন। যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় কোটা বৈষম্যের শিকার হয়েছে তাদেরই আন্দোলন।
কোটা সংস্কারে আন্দোলনকারীদের আহ্বায়ক বলেন, একটা জাতি কিভাবে চাকরিতে এরকম একটি অবব্যস্থাপনা বয়ে বেড়াতে পারে জানি না। অনেকেই বলে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, স্বাধীনতার অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় সুবিধাভোগী তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। আমাদের দাবি একটাই, কোটা সংস্কার করে ১০ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। আর এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি আমাদের দিকে তাকাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
কোটা সংস্কারের পক্ষে দাবি তুলে ধরে মামুন বলেন, বিসিএসসহ সব সরকারি পরীক্ষায় দেখা যায় কোটার কারণে অনেক কম নম্বর পাওয়া প্রার্থীও চাকরি পান। অথচ অধিক নম্বর পাওয়া প্রার্থী বাদ পড়ে যান কোটার যাঁতাকলে পড়ে। মেধা তলিকায় শুরুর দিকে থেকেও যেখানে সাধারণ প্রার্থীরা চাকরি পান না সেখানে সর্বশেষ প্রার্থীও এডমিন ক্যাডার হয়ে যান। তিনি বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে বলেন, বর্তমানে কেউ বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২৬তম হলেও এডমিন ক্যাডার পাবেন না। আর সেখানে চার হাজারতম স্থান নিয়েও এডমিন ক্যাডার হয়ে যাচ্ছেন। ‘কোটা সংস্কার আমাদের বাঁচার দাবি, সব শিক্ষার্থীদের দাবি’। আমাদের সঙ্গে সাধারণ সব শিক্ষার্থীদের একাত্মতা রয়েছে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের আন্দোলনে কোটায় সুবিধাভোগী ব্যতীত সবার এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সমর্থন রয়েছে।
বিগত পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষায় দেখা গেছে কোটায় প্রার্থী না পাওয়ায় অনেক শূন্যপদ রয়ে গেছে। ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি, ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি, ৩০তম বিসিএসে ৭৮৪টি, ৩১তম বিসিএসে ৭৭৩ এবং ৩৫তম বিসিএসে ৩৩৮টি পদে প্রার্থী না পওয়ায় শূন্য পদ রয়ে যায়। যদি কোটা সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে থাকতো তাহলে আর মেধাবীদের বাদ পড়তে হতো না। এমন শূন্য পদ থাকতো না।
এর বাইরেও কোটায় বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা, কোটা এবং সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগে বয়সে ভিন্নতা রয়েছে। এটা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আমরা বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা এবং সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে কোটাধারীদের বয়সের তারতম্য অভিন্ন করার দাবি জানাই।
মামুন বলেন, কোটা সংস্কার না করেই আবার নতুন করে কোটা ব্যবস্থায় লোকজন ঢুকানোর আঞ্জাম করা হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের কিছুটা অধিকার আছে দেশের প্রতি। তাদের ছেলে-মেয়েরা সে সুযোগ সুবিধাও পায়। কিন্তু তাদের কয়েক প্রজন্ম এ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ প্রথা বাদ দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। শুনেছি আবার নাকি দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধার নতুন তালিকা করা হচ্ছে। তার মানে আরো কয়েকগুণ কোটাধারী তৈরি করা হচ্ছে। আর এ তালিকার নামে চলছে মহা দুর্নীতি। অনেকেই টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে যাচ্ছেন। আর এটায় যে দুর্নীতি হচ্ছে তা স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রী এবং ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেছেন। তারা বলেছেন, এখন যে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হচ্ছে তার পাঁচভাগও মুক্তিযোদ্ধা নাই। যা কোটা কম থাকলে নিয়োগে দুর্নীতিও অনেক কমে যেত বলে মনে করেন তিনি।
কোটা বৈষম্যের কারণে যেখানে অনেক মেধাবী ভাইভা থেকে ছিঁটকে পড়েন সেখানে একই পরিবার থেকে তিন জন পুলিশ ক্যাডারে চাকরি পাওয়ার নজিরও আমরা দেখেছি। কোটায় একজন চাকরি পেলেই একটা পরিবারকে টেনে নিতে পারে। অক্ষম এবং নিম্ন শ্রেণির মানুষকে টেনে নেয়ার জন্য একটা পরিবারে একজনকে সুযোগ দেয়া মেনে নেয়া যায় সেখানে এই পরিবারে তিন জনের এমন সুযোগ এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মও সুযোগ পেয়ে যাবে এটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে একরকম প্রতারণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের আবাসিক এ শিক্ষার্থী বলেন, গতবছর আমার হলের এক চাকরি প্রার্থী দুইবার বিসিএস পরীক্ষায় ভাইভা দিয়েও চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর পরে দেখা যায় তিনি ৩৮তম বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষায় টিকেছেন। কিন্তু তার আর ভাইভার সুযোগ নেই। নিয়তি আর কোটার কাছেই তার হার মানতে হয়েছে। গত ১০ বছরে এ হলের অন্তত ১৫ জন এমন চাকরি প্রার্থী বিভিন্ন পরীক্ষায় ভাইভা দিয়ে চাকরি না পেয়ে হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন বলে তিনি জানান। তাদের কথা কেউ ভাবছে না। একটা ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বান্দোবস্ত হতে পারে না। এভাবে চললে দেশ পিছনের দিকে যাবে সামনে আর অগ্রসর হতে পারবে না।
মামুন বলেন তার বাবাও একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের একটি ইউনিট প্রধান ছিলেন। তখনকার ছাত্রলীগের প্যাডে সাক্ষর করা সনদ নিয়ে ১০০ এর উপরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছেন। তারা বিভিন্ন সুবিধাও ভোগ করেছেন। কিন্তু তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি। তিন চান তার সন্তানেরা কোটায় নয়, মেধায় চাকরি পাক। আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সমর্থন রয়েছে। তাদের অনেকে আমাদের আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করছে। কোটা ব্যবস্থা সংস্কার হলে দেশের ৩০ লাখ বেকার যুবকের কর্মংস্থান হবে বলেও তিনি জানান।
আন্দোলনকারীদের এ আহ্বায়ক জানান, বৃহস্পতিবার তাদের অহিংস আন্দেলনে পুলিশ ইচ্ছাকৃত হামলা চালিয়েছে। তারা বিনা উস্কানিতে লাঠিচার্জ এবং টিআর গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। এটা তাদের সঙ্গে চরম অবমাননাকর। এসব পুলিশ হয়তো কোটায় চাকরি পেয়েছে তা না হলে এরকম অতর্কিত হমলা করতে পারে না বলেও তিনি জানান। পুলিশের লাঠিচার্জের প্রতিবাদে আগামীকাল দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও জানান তিনি। বৃহস্পতিবারের হমলার পরে পুলিশ বাদী হয়ে ৭০০/৮০০ জন অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা করেছেন বলে তিনি জেনেছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status