এক্সক্লুসিভ

শোকে কাতর রাগীব-রাবেয়া

এগারো স্বপ্ন মিশে গেল ত্রিভুবনের সবুজ ঘাসে

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৪ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ৭:২১ পূর্বাহ্ন

আর ক’দিন পরেই রেজাল্ট। এমবিবিএস পাস করে ডাক্তার লিখতেন নামের পাশে। স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতো দু’মাসের মধ্যেই। কিন্তু সেই স্বপ্ন মিশে গেল ত্রিভুবনের সবুজ ঘাসে। নির্মম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলো এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেয়া ১১ শিক্ষার্থী। আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ওই শিক্ষার্থীদের দুই শিক্ষার্থী। তাদের নাম প্রিন্সি ধাম ও সামিরা বায়ানজানকর। তাদের ফিরিয়ে আনতে চলছে প্রাণান্তকর চেষ্টা। এমন ঘটনায় শোকাতুর হয়ে পড়েছে সিলেট। আর সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে চলছে শোকের মাতম। মুখে হাসি নেই কারও। শিক্ষক-ছাত্র এমনকি কলেজের দারোয়ানরা কাঁদছে। এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ-ই। সোমবার সকালে তারা ৫ বছরের শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে নিজ বাড়ি নেপালের পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন। যাওয়ার সময়ও তাদের চোখভর্তি ছিল জলে। ৫ বছরের চিরচেনা ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে তাদের মন চাইছিলো না। কেঁদেছিলেন অনেকেই। কিন্তু এই কান্নাই হবে তাদের শেষ কান্না। আর ফিরে আসবে না ওই এগারো শিক্ষার্থী। চিরদিনের মতো তারা হারিয়ে গেল ত্রিভুবনের দিগন্তের ওপারে। প্রার্থনা চলছে ধামি ও সামিরার জন্য। অন্তত তারা যেন ফিরে আসে মৃত্যুর দুয়ার থেকেÑ এমনটাই চাওয়া রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। রোববার শেষ হয় তাদের এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। ফলে সোমবার সকাল থেকে বাড়ি ফেরার তাড়াহুড়া চলে। ১৯তম ব্যাচের মধ্যে নেপালের ছাত্র সংখ্যা ছিল ৪০ জনের মতো। ১৩ জন ধরেছিলেন ইউএস বাংলা উড়োজাহাজের ফ্লাইট। অন্যরা ডাউকি-শিলং হয়ে নেপালের পথ ধরেন। ওই ১৩ জনে ছিলেন সঞ্জয় পাউডাল, সঞ্জয়া মেহেরজান, নিগা মেহেরজান, অঞ্জলি শ্রেষ্ঠ, পূর্ণিমা লুনানি, শ্বেতা থাপা, মিলি মেহেরজান, সারুনা শ্রেষ্ঠ, আলজিনা বড়াল, চারু বড়াল, আশনা সাকিয়া, প্রিন্সি ধামি ও সামিরা বায়ানজানকর। বিকালেই খবর আসে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবনে ইউএস বাংলার ফ্লাইট দুর্ঘটনার কথা। মুহূর্তে কালো ছায়া গ্রাস করে ফেলে সিলেটকে। রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। খবর নিয়ে জানা গেল ওই ফ্লাইটে মোট ১৩ জন শিক্ষার্থী ছিল। যারা ঢাকা থেকে ইউএস-বাংলার ওই ফ্লাইটে নিজ শহর কাঠমান্ডুতে যাচ্ছিল। রাতে তাদের নাম প্রকাশিত হলো। কিন্তু জানা গেল না তারা বেঁচে আছেন কিনা। রাতে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফেসবুক আইডিতে নাম আসে তখন জানা গেল যে ১১ জন শিক্ষার্থী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের আইসিসিইউতে রয়েছে প্রিন্সি ধামি ও সামিরা বায়ানজানকর। এই খবরটি বিশ^াস হচ্ছিল না কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। নেপালের আত্মীয়স্বজন সহ বিভিন্ন সূত্র খবর নিশ্চিত করতে থাকে। গতকাল দুপুরে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের উপ-পরিচালক ডা. আরমান আহমদ শিপলু জানান, আমরা প্রায় নিশ্চিত আমাদের ১১ জন শিক্ষার্থী মারা গেছে। ধামি ও সামিরা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তিনি বলেন, ওই ১৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২ জন ছেলে ও ১১ জন মেয়ে ছিল। যে দুইজন বেঁচে আছেন তারা মেয়ে। ওখানে তাদের আত্মীয়স্বজনরা আছেন। কলেজের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবরাখবর রাখছি। এমন মৃত্যু কারও কাম্য ছিল না বলে জানান ডা. শিপলু। গতকাল বিকাল পর্যন্ত খবরে জানা গেছে, ধামি ও সামিরার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তাদের শরীরের অনেক অংশ পুড়ে গেছে বলে নেপালে থাকা স্বজনরা নিশ্চিত করেছে। আর বাকি ১১ জন ছাত্রের মধ্যে অনেকেরই লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তারা পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। শিক্ষার্থী মৃত্যুর খবরে গতকাল সকাল থেকে সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে তিন দিনের শোক কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এ কারণে গতকাল কলেজ ক্যাম্পাসে ক্লাস ও পরীক্ষা হয়নি। পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। আর কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক প্রকাশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. আবেদ হোসাইন মানবজমিনকে জানিয়েছেন, আমরা শোক কর্মসূচি পালন করছি। আগামী তিন দিন তারা একই ভাবে শোক কর্মসূচি পালন করবেন।
প্রয়োজন হলে দ্রুত তাদের একটি দল নেপাল পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘ওই ১৩ শিক্ষার্থী ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। তারা দুই মাস পরে এসে রেজাল্ট নিতো। পাস করলেই তারা এমবিবিএস পাস করে ডাক্তার হয়ে যেতো। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা শোকাহত, মর্মাহতও। শোক জানানোর ভাষা আমাদের নেই।’ এদিকে সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে এখনো প্রায় আড়াইশ’ নেপালী শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। ত্রিভুবনে বিমান দুর্ঘটনার খবর তাদের কাছে পৌঁছামাত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে ক্যাম্পাসে। নেপালী শিক্ষার্থীরা কাঁদছে অঝোরে। ওই কলেজের বিদেশি হলগুলোতে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা রাতে ঘুমায়নি। সবাই কেঁদেছে। রাতের খাবারও খায়নি অনেকেই। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। গতকাল দুপুরে বিদেশি ছাত্রদের হলে গেলেও দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ওই শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে নিজেদের রুমে বসে কাঁদছিলো। কারও মুখে কোনো কথা ছিল না। শোকে যেন তারা নির্বাক হয়ে গেছে। সকালে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে ছুটে এসেছিলেন পার্কভিউ মেডিকেল কলেজের নেপালী শিক্ষার্থীরা। অঝোরে কেঁদেছে তারা। স্বজন হারানোর এই কান্নায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। এর আগে সোমবার রাতে নেপালী শিক্ষার্থীরা সিলেট নগরীর তেলিহাওর এলাকায় মোমবাতি র‌্যালি করেছে। নিহতদের স্মরণ করে এই র‌্যালি বের করা হয়। নেপালী কয়েকজন শিক্ষার্থী মানবজমিনকে জানান, ১৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে তারা গভীর শোকাহত। ‘ম্যাসিভ শকড’ হয়েছেন তারা। এখন তাদের নিয়ে নেপালে থাকা পিতা-মাতারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা বলেন, এমন মৃত্যুতে শুধু বাংলাদেশই নয়, কাঁদছে গোটা নেপালও।



   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status