বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (৩৯)

‘মনে পড়ছে সেদিনকার সেই বিকৃত নিয়মের ছবিগুলো’

৮ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:১৫ পূর্বাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-

বলেছিলাম ক’টা দিনের মধ্যে আবার ফিরে আসব স্টারে। সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। শেষের দিকে যখন স্টারে অভিনয় করছি সেই সময়ে বোধহয় ১৯৫৫-৫৬ সালে আমাদের লুনার ক্লাবের সিলভার জুবিলি উৎসব হলো। আমি বললাম, উৎসবে স্টারে সবাইকে দিয়ে আমরা পাড়ায় ‘শ্যামলী’ নাটক করব। কথাটা সলিল মিত্র মশাই শুনেছিলেন। এখনি মিত্র মশায়ের পক্ষে শিশির মল্লিক আমাকে ‘শ্যামলী’ নাটক করতে বারণ করলেন। বললেন, যে নাটক স্টারে চলছে সেটি কোনো পাড়ার প্যান্ডেলে হবে না। শিশিরবাবুর কোনো আপত্তি কেউ মানলেন না। সরযু মা অর্থাৎ সরযু দেবী, সাবিত্রী এমনকী স্টারের সকলেই একবাক্যে বললেনÑ হবে। এটা আমাদের বাড়ির থিয়েটারের মতো, সুতরাং আমরা করবই। শেষপর্যন্ত সবার দাবি জয়ী হলো। শুধু ‘শ্যামলী’ নাটকটি নেবার কথা ভেবেছিলাম, এবার হলো ঠিক তার উল্টো। স্টারের পুরো স্টাফ শুধু নয়Ñ সেট-লাইট সব নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির সামনে নরেশ বসুর বিরাট মাঠে স্টেজ তৈরি করে সেই ‘শ্যামলী’ হয়েছিল। সাবিত্রীর বাবার রোলে অভিনয় করেছিল লালু (রবি রায়ের পরিবর্তে) আমি সেই অনিলের পার্ট করেছিলাম। বিজয় চ্যাটার্জি, শম্ভু ব্যানার্জি (এরা আমার আত্মীয়) অভিনয় করেছিল। সুলালদা অসুস্থ ছিলেন বলে তার রোলে অভিনয় করেছিল বুড়ো। তরুণকুমার। তারপর বেশিদিন থাকা হয়নি। ছবির ব্যস্ততা এড়িয়ে আর আমি ফিরে আসতে পারিনি ‘শ্যামলী’র আঙিনায়। একটি ছবির কাজ শেষ করি, আবার একটির আহ্বান আসে। ছবির সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। ঠিক এমন সময় আমাকে একটা মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো। মনে পড়ছে সেদিনকার সেই বিকৃত নিয়মের ছবিগুলো।
সিনেমা জগতে সেদিন যে রীতি চালু ছিল আজ অবশ্য তা নেই। সেই বিকৃত রীতির আমি স্বয়ং একজন শিকার ছিলাম, এই মুহূর্তে সেই কথাই আমার মনে পড়ে গেল। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। মনে পড়লে ব্যথিত হই। মনটা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চায়।
জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে কী জানি কেন তখনকার সেই জগণ্য মনোবৃত্তির মানুষগুলোর সামনে আমার রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়েছিল। রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলাম যদি এই ঘৃণ্য ধারাকে ভেঙে দিতে না পারি তা হলে, আমার মূল্য কোথায়, সেই কথা ভেবে।
নিজের মূল্য যাচাই করার জন্য সেদিন আমি বিন্দুমাত্র উৎসাহিত হইনি। ওদের মূল্য ওরা পান সেই ইচ্ছাটাই যেন তখন আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমার মনে হয়েছিল ছবির জগতে যাদের মূল্য সবচেয়ে বেশি, যারা ছবি তৈরির প্রাণস্বরূপ, তাদের যদি প্রতি পদক্ষেপে অপমান মাথায় নিয়ে চলতে হয় তা হলে ওরা যে একদিন ফুসে উঠবেনই। আমি ওদের অর্থাৎ আমার প্রিয় কলাকুশলীদের মনের সেই জ্বালা উপলব্ধি করেছিলাম মর্মে মর্মে। ওরা অর্থাৎ সিনেমা জগতে যারা সাহেব নন, বিবি নন, শুধুমাত্র গোলাম। সেই বিচিত্র ধারা বা রীতি কেমন ছিল তারই একটা ছবি তুলে ধরি এখানে।
নামকরা শিল্পীদের জন্য স্পেশাল খাদ্যের আয়োজন করবেন প্রোডিউসাররা। আর অল্প দামি শিল্পী ও নিম্নস্তরের কলাকুশলীদের জন্য অতি সাধারণ খাদ্যের ব্যবস্থা। যাকে বলে অখাধ্য। খাদ্য পরিবেশনেও প্লেটের পরিবর্তে শালপাতা।
মনে পড়ে, প্রথম প্রথম সেই শালপাতায় আহার করার দিন একদিন আমারও ছিল। ওদের নিয়মের সঙ্গে আমারও খাবার আসত একই নিয়মে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status