মত-মতান্তর

প্রথম বর্ষ থেকেই ই-লাইব্রেরির ব্যবহার বাধ্যতামূলক হোক

মো. আল-আমিন

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৮:৫৮ পূর্বাহ্ন

চারিদিকে কপি-কাটের রাজত্ব। চুটিয়ে ব্যবসা করছে ফটোকপির দোকানিরা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সঙ্গে গবেষণায় মন না দিয়ে সময় ব্যয় করছে বিশ^বিদ্যালয়ের আশ-পাশের কম্পিউটারের দোকানে। অ্যাসাইনমেন্ট, টার্মপেপার থেকে শুরু করে প্রজেক্ট, থিসিসসহ সব ধরনের গবেষণাও মিলছে এসব দোকানে। শিক্ষার্থীরা গাদা গাদা বই পড়ার ঝামেলায় না গিয়ে দেদারসে কিনছে এসব রেডিমেট ডকুমেন্ট। এ যেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’। অথচ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সবকিছুই চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের বদৌলতে নিমিষেই দেশ-বিদেশের সকল তথ্য মাউসের এক ক্লিকেই পেয়ে যাচ্ছি। এখন আর গাদাগাদা ক্যাটালগ ঘেটে বই খুজে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ই-লাইব্রেরির কল্যাণে গুগল বা নির্দিষ্ট লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে সার্চ করলেই সামনে চলে আসছে সব। কিন্তু এই ই-লাইব্রেরির ব্যবহার না জানায় অসংখ্য ও অগণিত তথ্য-উপাত্তের মাঝে নিয়মিত হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। আর এই সমস্যা উত্তোরণের একমাত্র সমাধান হতে পারে একটি আদর্শ ও মান-সম্মত ই-লাইব্রেরি। যেখানে সহজেই পাঠক খুঁজে পাবে তার প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত।
শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে পর্যাপ্ত তথ্য আদান-প্রদানের অভাবে মান-সম্মত গবেষণা থেকে শুরু করে মেধা ও মননে বিকাশ থেকেও দেশ-জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতির উত্তোরণে একজন শিক্ষক খুব সহজেই ই-লাইব্রেরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন শিক্ষার্থীদের। ¯œাতক প্রথম বর্ষ থেকেই লাইব্রেরি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে এবং সাপ্তাহিক বিভিন্ন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে লাইব্রেরির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে বেঁধে ফেলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক লাইব্রেরিয়ানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান চর্চার পরিধি ও গতিবিধি মনিটরিং করতে পারেন।
একই সঙ্গে শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর এবং লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্কও হতে হবে উন্নত এবং সুদৃঢ়। যতোদিন এটি না হবে ততোদিন গাণিতিক হারে স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় ও লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়লেও একই হারে কমতে থাকবে শিক্ষার প্রকৃত মান ও পাঠকের সংখ্যা। একটি পরিবেশ বান্ধব ই-লাইব্রেরি হতে পারে পাঠকের জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবারনের সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। ১৩ শতকের জনপ্রিয় পার্শিক বিজালাল আদ-দিন মুহাম্মদ রুমী বলেছেন, আমাদের চারদিকে সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত একে বুঝতে একটি বাগানে হাটার প্রয়োজন। ঠিক একই রকম ধারাবাহিক, সুশৃঙ্খল ও সুসংঘবদ্ধ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে লাইব্রেরির কোনো বিকল্প নেই। বিশ^ব্যাপী তথ্য-উপাত্ত, চিন্তা-চেতনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের এক মহাসমুদ্্র হলো লাইব্রেরি। একজন নাবিক যেমন যাত্রীদেরকে নিরাপদভাবে পারাপারের ক্ষেত্রে মোক্ষম ভূমিকা পালন করে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে একজন দক্ষ লাইব্রেরিয়ান জ্ঞানের এই মহাসমুদ্রে প্রত্যেক পাঠককে অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সকল লাইব্রেরি পাঠকহীনতায় ভুগছে। শুধু বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীক লাইব্রেরিগুলোতে শিক্ষার্থীদের পদচারণা লক্ষ করা যায়। কিন্তু অন্য সব লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা একেবারে নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে লাইব্রেরিগুলো পাঠক ছাড়া মৃত গৃহের মত হয়ে পড়েছে। অথচ প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে মনের হাসপাতাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থাগার আইন পাসের ১৬৮ বছর পর দেশে প্রথমবারের মতো ৫ই ফেব্রুয়ারি পালিত হয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এই উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন- গ্রন্থাগার হল জ্ঞানের ভান্ডার, জ্ঞানার্জন, গবেষণা, চেতনা ও মূল্যবোধের বিকাশ, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত করে তোলা এবং পাঠাভ্যাস নিশ্চিত করণে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম।
একুশ শতকের সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তথ্য জ্ঞানের আলোয় গোটা দেশকে আলোকিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও বৃটিশ কাউন্সিলের যৌথ উদ্যেগে অতি শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে ‘লাইব্রেরিস আনলিমিটেড’। প্রাথমিকভাবে ৩০টি আদর্শ লাইব্রেরি এবং একটি ই-লাইব্রেরি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। উন্নত করা হবে আরো ৩৯টি লাইব্রেরি। ফ্রি ইন্টারনেটসহ সব ধরনের অত্যাধুনিক সেবা নিশ্চত করা হবে। বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য থাকবে আলাদা জায়গা। বিশ^মানের ট্রেনিং দেয়া হবে লাইব্রেরিয়ানদের। ডিজিটাল লিডারশীপ, কাস্টমার সার্ভিস, আইসিটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দেয়া হবে সঠিক প্রশিক্ষণ। বর্তমান সময়ে কিছু দক্ষ লাইব্রেরিয়ান পাঠকদের সুবিধার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি চালু করা হয়েছে ওপেন এক্সেস বাংলাদেশ নামে একটি ওয়েব পোর্টাল। যার মাধ্যমে একজন পাঠক, শিক্ষার্থী কিংবা গবেষক বিভিন্নভাবে উপকৃত হতে পারবে। এক্সেস করতে পারবে সকল সরকারী ও বেসরকারী ডেটা।
ই-লাইব্রেরির আধুনিকায়নে বিশে^র বিভিন্ন বিখ্যাত লাইব্রেরির সঙ্গে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা খুবই জরুরি। এবং লাইব্রেরি গুলোকে পরিবেশ বান্ধব করার পাশাপাশি পাঠকদের অনলাইন ও অফ লাইন ভিত্তিক সুবিধা প্রদান করতে হবে। গবেষকদের গবেষণা কার্যক্রমের জন্য নিতে হবে কার্যকারী পদক্ষেপ নিয়মিত পাঠকদের মধ্যে প্রতি মাসে জ্ঞান ও সাহিত্য মূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এবং যদি আমরা বাংলাদেশের সকল স্বনাম ধন্য লাইব্রেরি গুলোতে যে সমস্ত বই বিশেষ করে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও গবেষণা মূলক উপন্যাস/প্রবন্ধগুলো যদি ইংরেজিতে অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা একটি ডিজিটাল ফরমেটে এবং বিশে^র বিখ্যাত বই, জার্নাল, সাময়িকী ইত্যাদি সবকিছুই বাংলায় অনুবাদ করে অনলাইন ভিত্তিক করে দিতে পারি তাহলে আমাদের তরুণ সমাজ যেমন উপকৃত হবে ঠিক একই ভাবে জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে বাংলা ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ব্যপকভাবে পরিচিতি লাভ করবে। মানুষ মূলত খাবারের জন্য বেঁচে থাকে না, বরং বাঁচার জন্য খায়। ঠিক তেমনি কোন পাঠক বই পড়ার জন্য বেঁচে থাকে না বরং ভালোভাবে বাঁচার জন্য বই পড়ে। আর এই পড়াটা তখনি সার্থক হবে যখন পাঠকের কাছে ই-লাইব্রেরিই হবে দ্বিতীয় আবাসস্থল।
[আলীম/এমকে]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status