শেষের পাতা

প্রশ্নপত্র ফাঁস

কূল-কিনারা পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

শুভ্র দেব

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:৪৮ পূর্বাহ্ন

ধারাবাহিকভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। চলমান এসএসসি পরীক্ষার শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস। কিন্তু এই চক্রের হোতাদের শনাক্ত করতে কূল-কিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের কাছে অনেকটা অসহায় তারা। নানা উদ্যোগ, নজরদারি এবং প্রশ্নফাঁস চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত চালালেও মূল হোতাদের কিছুতেই ধরতে পারছেন না তারা। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা 
দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে যাচ্ছে চক্রগুলো। সর্বশেষ গতকাল পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে উত্তরসহ প্রশ্ন ফাঁস করেছে এই চক্র। এই চক্র অধরা থাকলেও হাতে প্রশ্ন পাওয়া শিক্ষার্থীরা শাস্তির মুখে পড়ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবারই বেশ দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। কিন্তু সবাইকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতাদের কাছে হার মানতে হচ্ছে। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কয়েকজনকে আটক করলেও মূলহোতারা থাকছে অধরা। অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজি প্রেসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। আর তারা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে আরো কিছু অসাধু শিক্ষার্থীদের। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা বলছে, তারা এখন পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারো সম্পৃক্ততা পাননি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও উপ-কমিশনার মো. আলিমুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমরা ১৩টি চক্রকে শনাক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু এর বাইরে আরো অনেক গ্রুপ আছে যাদের শনাক্ত করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাছি। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে- যাদের আমরা শনাক্ত করেছি তারা প্রত্যেকেই মধ্যস্বত্বভোগী। তারা শুধু টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সংগ্রহ করে। তবে কারা এসব গ্রুপের এডমিন তাদের শনাক্ত করতে পারছি না। তদন্তকালে যাদের সঙ্গেই আমরা কথা বলেছি তারা শুধু বলে আমরা ওই গ্রুপ থেকে প্রশ্ন পেয়েছি। আবার ওই গ্রুপকে জিজ্ঞেস করলে বলে- আমরা ওই গ্রুপ থেকে পেয়েছি। এছাড়া এসব গ্রুপের এডমিনকে শনাক্ত করার জন্য আমরা ফেসবুকের কোনো সাহায্য পাচ্ছি না। তারা আমাদের আবেদনে তেমন কোনো সাড়া দেয় না। চক্রের হোতারা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক ও ভাইবারে গ্রুপ সৃষ্টি করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে। শুধু প্রশ্ন ফাঁসের জন্যই তারা এসব গ্রুপ সৃষ্টি করে। প্রয়োজনবোধে তারা গ্রুপের সদস্যদের গ্রুপ থেকে বের করে দেয়। এজন্য মূল হোতাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে গেছে। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। তারা ১৬ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। তাদের মধ্যে ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৪ জনকে আটক করে একটি সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। ওই ১৪ জনের মধ্যে তিন সহোদরও ছিল। তারা উল্লাবাহিনী নামে পরিচিত। সংবাদ সম্মেলনে ডিবি’র যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছিলেন, খুব গোপনীয়তা বজায় রেখে তারা এই কাজ করে। এই চক্রের সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি জড়িত। যখন পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র পরীক্ষা কক্ষে নেয়া হয় তখনই কোনভাবে মোবাইলে ছবি তোলা হয়। তারপর তাদের ফেইক আইডি দিয়ে পরিচালিত ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে ও ইমোর গ্রুপে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেই ছবি। এসব গ্রুপের এডমিন হিসেবে তারা কাজ করে থাকে। এডমিনদেরও আবার আলাদা আলাদা গ্রুপ থাকে। তারাই প্রশ্ন বিক্রির জন্য গ্রুপে সদস্য বাড়ানোর কাজ করে থাকে। বাতেন বলেন, আগের দিন তারা ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট আগে সঠিক প্রশ্ন বের করে নিয়ে আসে। আর এসব প্রশ্নপত্র তারা ৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তরের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. শাহজাহান মানবজমিনকে বলেন, যাদেরকে আমরা আটক করেছি তাদের দেয়া তথ্যমতেই আমরা তদন্ত করছি। কিন্তু কোনোভাবেই মূল চক্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছি না। আর মূল চক্রকে ধরতে না পারলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না। আমরা বিকাশ, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক ও ভাইভারের সূত্র ধরে ৩০০টি মোবাইল নম্বর ব্লক করে দিয়েছি। এদের মধ্যে অভিবাবক, শিক্ষার্থী ও মধ্যেস্বত্বভোগীদের মোবাইল নম্বর রয়েছে। তিনি বলেন, ৩০০ নয়, তিন হাজার নম্বর ব্লক করে কোনো লাভ হবে না। কারণ ওয়েব সাইটে প্রবেশ করলে দেখা যায় হাজার হাজার গ্রুপ রয়েছে। সবাই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। আমরা যাদেরকে আটক করি তারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সংগ্রহ করে। তাদেরকে আটক করে আদতে কোনো কাজ হচ্ছে না। ডিবি’র এই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো সুফল নাই। আমাদের একার পক্ষে কাজ করাও সম্ভব না। যদি না অভিভাবকরা সচেতন হন। কারণ লাখ লাখ অভিবাক প্রশ্ন ফাঁসের পক্ষে। আর আমরা গোটাকয়েক মানুষ কিভাবে রোধ করব। তাই অভিভাবকদেরই আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে। না হলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি কাজ করছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ইতিমধ্যে র‌্যাব সদস্যরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চক্রে জড়িত অনেকেই গ্রেপ্তার করেছে। তাদেরকে নিয়েই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতাদের আটকের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। গতকাল র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, মূল হোতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২/৪ জন থাকতে পারে। তাদের মাধ্যমেই শ’ শ’ মোবাইলে পৌঁছে যাচ্ছে প্রশ্ন। তাই এডমিনকে আটকের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। অনুসন্ধান ও কিছুদিন তাদের পেছনে লেগে থাকলে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমরা মূলত অ্যাপস মনিটরিং ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি। তারা আসলে কার কাছ থেকে প্রশ্ন পায়। সেই সূত্র ধরে গেলে এডমিন পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি এবং ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই দুই কমিটির সদস্য সংখ্যা হবে পাঁচজন করে। আদেশের কপি পাওয়ার সাতদিনের ভেতরে কমিটিকে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে এবং এক মাসের মধ্যে দুই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি ইকবাল কবির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন। রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, বিচারিক তদন্ত কমিটির কাজ হচ্ছে, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের কী শাস্তি হওয়া উচিত, তা খুঁজে বের করা এবং নির্ধারণ করা। আর প্রশাসনিক কমিটির কাজ হচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, কী কী সমাধান আছে, সেগুলো নির্ধারণ করা। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন আদালত। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, আইন সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং উইংয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, তথ্য প্রযুক্তি সচিব, বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান ও সচিব, বিটিসিএল প্রধান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক, ঢাকাসহ সকল শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্‌রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status