বাংলারজমিন

‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আশায় বেঁচে আছি’

রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৭:৫১ পূর্বাহ্ন

ভাষা সৈনিক মিরান উদ্দিন। এক সময়কার টগবগে যুবক বয়সের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও মনোবল হারায়নি। মহাকাশের ডাকে সারা দেয়ার আগে তিনি দেখে যেতে চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বুকভরা সেই আশা নিয়েই তিনি বেঁচে আছেন। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মিরান উদ্দিন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু হরফ চলবে না- এমন নানা স্লোগানে স্লোগানে সেদিন গ্রামীণ জনপদ কাঁপিয়ে তুলেছিলেন টগবগে এই যুবক। বই পড়ে আর নাতি-নাতনি নিয়ে গল্প গুজব করেই সময় কাটছে এই মানুষটির। ভাষার এই মাসে সকলের কাছে তার কদর থাকলেও বছরের বাকি সময়ই কেউ তার খোঁজ রাখে না। এমন কষ্টও তাকে পীড়া দেয়। অথচ মায়ের ভাষার জন্য যিনি আন্দোলন করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, লিফলেট বিতরণ করেছেন, মামলা খেয়েছেন, জেল খেটেছেন এবং পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কথা হয় মানিকগঞ্জে একমাত্র জীবিত ভাষা সৈনিক মহান এই মানুষটির সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে একবুক কষ্ট নিয়ে বলেন এক মেয়ে, দুই নাতি-নাতনি নিয়ে ভালো আছি। বন্ধু ওয়াজেদ উদ্দিন মাস্টার, নিরঞ্জন বসু, রেহাজউদ্দিন পরপারে চলে গেছেন। এখন হয়তো আমার পালা। বলেন, ভাষার মাস এলেই তোমরা সাংবাদিকরা আমার খোঁজে ছুটে আসো। বাকিটা বছর কেউ খবর নেয় না। আমার জীবনী নিয়ে পেপার পত্রিকায় কত লেখা ছাপালে, টেলিভিশনে দেখালে, কিন্তু এরপর কেউ তো কোনো খোঁজ নেয় না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তেমন কোনো চাওয়া পাওয়ার নেই। শুধু একটু সম্মান আর একটু স্বীকৃতি ছাড়া আর কিছু চাই না। সেই টুকু পেলে মরণের আগে একটু স্বান্ত্বনা খুঁজে পেতাম, আর পরিবার পরিজনের কাছে অন্তত বলতে পারতাম ভাষার জন্য সংগ্রাম করে আজ জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সন্তানরা যেন বাবাকে নিয়ে গর্ব করে বলতে পারে আমার বাবা একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক ছিলেন। পল্লী গ্রাম থেকে ভাষার আন্দোলনে কিভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন সেই স্মৃতিময় কথাগুলো বলতেই ফিরে যান সেই কৈশরে। তারা ৫ বন্ধু নবম শ্রেণির মিরান উদ্দিন, ওয়াজেদ উদ্দিন, নিরঞ্জন বসু, দশম শ্রেণির রেহাজউদ্দিন ও ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী যতিন দাস ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে। সে সময় তার চারবন্ধু পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। আর পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন মিরান উদ্দিন। মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিতে মিছিল, মিটিং করাই এদের অপরাধ। ঘটনার সময়কাল ১৯৪৯ সাল। মাত্র কিছুদিন আগে পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিয়েছেন একমাত্র উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো পূর্ববঙ্গ। তার ঢেউ এসে পৌঁছায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামেও। ঢাকা থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের কাছে পাঠিয়ে দেন বাংলা ভাষার দাবিতে কিছু লিফলেট। নির্দেশনা অনুযায়ী ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা বের করেন বিক্ষোভ মিছিল। পরে সমাবেশও করেন। মিছিল ও সামাবেশের নেতৃত্বে ছিলেন নবম শ্রেণির মিরান উদ্দিন, ওয়াজেদ উদ্দিন, নিরঞ্জন বসু, দশম শ্রেণির রেহাজউদ্দিন, ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী যতিন দাস। দিনটির তারিখ স্মরণ করতে পারলেন না ১৯৩৪ সালের ২৮ আগস্টে জন্ম নেয়া বর্তমানে প্রায় ৮৪ বছরের বৃদ্ধ মিরান উদ্দিন। তবে সেদিন স্কুল প্রাঙ্গণের পলাশ গাছটি ফুলে ফুলে রক্তিম ছিল। এ থেকে তিনি ধারণা করলেন মাসটি ফাল্গুন। জানালেন, তিনি ছিলেন নবম শ্রেণির ক্লাস ক্যাপ্টেন। সেদিন স্কুলে আসার পর তাকেসহ ওয়াজউদ্দিন, রেহাজউদ্দিন, নিরঞ্জন, যতিনকে ডেকে পাঠান স্কুলের শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী ও আফসার উদ্দিন। ঢাকায় বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে তাদের বোঝান দুই শিক্ষক। বলেন উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তা হলে বাঙালিদের নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবে না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। ঢাকা থেকে ছাত্র সংগ্রামের পাঠানো লিফলেট তাদের হাতে দিয়ে বলেন এগুলি ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের মাঝে বিলি করতে হবে। প্রতিবাদে করতে হবে মিছিল ও সামাবেশ। মিরান উদ্দিন বলেন ঐ লিফলেটের মূল বক্তব্যটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু হরফ চলবেনা। প্রিয় দুই শিক্ষকের আহ্বানে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন ছাত্ররা। সকাল দশটার দিকে স্কুলের সব ছাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে মিছিল নিয়ে এগুতে থাকেন প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ঘিওর সদরের দিকে। নদীর ঘাটে এসে লোকজন ছাত্রদের আর এগুতে মানা করেন। তারা জানান, ঘিওর থানায় পুলিশরা রাইফেল তাক করে অবস্থান নিয়েছে। মিছিল নিয়ে গেলে গুলি করতে পারে। আলোচনা করে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গ্রামের ভিতর দিয়ে মিছিল নিয়ে ফিরে আসে স্কুল প্রাঙ্গণে। সেখানে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্র নেতারা।
সেসময় মিরান উদ্দিন লজিং থাকতেন তেরশ্রী গ্রামে মীর সাহেবের বাড়িতে। মিছিল মিটিং শেষে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলছিলেন গ্রামের মাঠে। হঠাৎ করে মীর সাহেব এক ছেলের মাধ্যমে খবর পাঠান মিরানকে সরে পড়তে। স্থানীয় চেয়ারম্যান তাইজুদ্দিন ঠাকুরের মাধ্যমে তিনি খবর পেয়েছেন যে ছাত্ররা মিছিল, মিটিং আর লিফলেট বিলি করেছে তাদের পুলিশ গ্রেফতার করবে। মীর সাহেবের পরামর্শে মিরান উদ্দিন আশ্রয় নেন বড় মিলান গ্রামের সাত্তার মুন্সীর বাড়িতে। উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে রাত পার করেন। সকালে জানতে পারেন পুলিশ গ্রেফতার করেছে ওয়াজেদ উদ্দিন, রেহাজ উদ্দিন, নিরঞ্জন এবং যতিনকে। তার খোঁজে মীর সাহেবের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এছাড়াও আরও অনেকের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। দুপুর নাগাদ খবর পান আটক ছাত্রদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রহ মামলা দিয়ে মানিকগঞ্জ কোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বুঝতে পারেন তেরশ্রী গ্রামের এত কাছে সাত্তার মুন্সীর বাড়িও নিরাপদ নয়। রাতে আঁধারে সরে পড়েন। এরপর দূরের আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকেন প্রায় দুমাস। এরমধ্যে আটক ছাত্রদের মানিকগঞ্জ কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও এমসিএ ভাবেশনন্দী তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেন। এক পর্যায়ে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এরপরই মিরান উদ্দিন আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন। মিরান উদ্দিন বলেন, ভাষা আন্দোলন আমাকে অধিকার সচেতন করে তুলেছে, দেশের প্রতি ভালোবাসা শিখিয়েছে। শুধু ভাষার মাসই নয় সারা বছরই যেন ভাষা সৈনিকদের কদর থাকে। আর আমার দাবি একটাই যারা মায়ের ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন আর যারা এখনো স্বীকৃতি পাননি সরকারিভাবে যেন তাদের মর্যাদা দেয়া হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status