খেলা

পরিশ্রমী এক মহৎ ফুটবলারের গল্প

পিন্টু আনোয়ার

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

টটেনহ্যামের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে বল পায়ে ম্যাজিক দেখান মোহাম্মদ সালাহ। আর ম্যাচ শেষে তার নাম ওঠে গর্বের রেকর্ডে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে সাইদাম্পটনের বিপক্ষে জয়েও গোল পান তিনি। জাতীয় দলকে ২০১৮ বিশ্বকাপের টিকিট এনে দিয়ে নিজ দেশ মিশরে জাতীয় বীরের মর্যাদা পান মোহাম্মদ সালাহ। আর তার মহতী মনোভাবের জন্য নিজ দেশে ‘সামাজিক আইকন’ হয়ে উঠেছেন তিনি। এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ৩৪.৩ মিলিয়ন পাউন্ডের ট্রান্সফারে ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমা থেকে লিভারপুলে পাড়ি দেন মোহাম্মদ সালাহ। লিভারপুলের জার্সি গায়ে ইতিমধ্যে ৩৫ ম্যাচে ২৯ গোল পেয়েছেন এ মিশরি ফরোয়ার্ড। আর ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে জোড়া গোল করেন সালাহ। ২-২ সমতার ওই ম্যাচে সালাহর দ্বিতীয় গোলটি ছিল অসাধারণ। বল পায়ে মাঠের ডানপ্রান্ত দিয়ে প্রতিপক্ষ তিন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে টটেনহ্যামের ডি বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। পরে দারুণ দক্ষতায় পরাস্ত করেন টটেনহ্যামের তারকা গোলরক্ষক হুগো লরিসকে। সালাহর গোলটিকে ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসির সঙ্গে তুলনা করেন বোদ্ধারা। ওই ম্যাচে নিজের প্রথম গোল শেষে গর্বের রেকর্ড গড়েন মোহাম্মদ সালাহ। লিভারপুলের জার্সি গায়ে প্রিমিয়ার লীগে কম ম্যাচে ২০ গোলের রেকর্ডটি মোহাম্মদ সালাহর। ২৫ ম্যাচে ২০ গোল পূর্ণ করেছেন তিনি। এতে তিনি ভেঙে দেন লিভারপুলের স্প্যানিয়ার্ড স্ট্রাইকার ফারনান্দো তোরেস ও ইংলিশ ফরোয়ার্ড ড্যানিয়েল স্টারিজের রেকর্ড। ২৭ ম্যাচে ২০ গোলের নজির রয়েছে উভয়ের। গত অক্টোবরে বাছাইপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে কঙ্গোর বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় নিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপের টিকিট কাটে মিশর। ওই ম্যাচে মিশরের দুই গোলই করেন মোহাম্মদ সালাহ। এতে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে খেলার মর্যাদা কুড়ায় মিসর। গত মাসে নিজ দেশের সরকারি ‘তাহিয়া মিশর’ তহবিলে ২০০০০০ পাউন্ড অনুদান দেন মোহাম্মদ সালাহ। মিশরের উত্তরাঞ্চলে ঘারবিয়ার নাগরিগ শহরে মোহাম্মদ সালাহ স্থানীয় উঠতি খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন আধুনিক খেলার মাঠ ও জিমনেশিয়াম। মোহাম্মদ সালাহ ৩০০০০ ইউরো অনুদান দিয়েছেন মিশরের বয়স্ক খেলোয়াড়দের কল্যাণ তহবিলে। পার্শ্ববর্তী শহরে বাসিউন সেন্ট্রাল হসপিটালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সাজানো হয় সালাহ্‌র দেয়া অনুদানের অর্থে। সালাহর উদ্যোগে লাগরিগে শুরু হয়েছে এক মসজিদ কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজেরও। আর বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে কঙ্গোর বিপক্ষে ম্যাচে তার গোলের জন্য সালাহকে একটি বিলাসবহুল বাড়ি উপহার দেন মিশরের এক ধনকুবের ব্যবসায়ী। তবে সালাহ সেই উপহার ফিরিয়ে দিয়ে ওই বাড়ির সমুদয় মূল্য মিশরের এক দাতব্য তহবিলে দান করেন। ক্যারিয়ারের শুরুটা কঠিনই ছিল মোহাম্মদ সালাহর। মিশরের ঘরোয়া ফুটবলে এল মোকালুন ক্লাবের জার্সি গায়ে অভিষেক তার। আর ১৪ বছর বয়সে নিজ শহর থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা বাসে চেপে রাজশাদী কায়রোর মোকালুন ক্লাবের অনুশীলন মাঠে পৌঁছতেন তিনি। আর কোনো কোনো দিন আসা যাওয়াও পাঁচবার করে ট্রেন বদল করতে হতো তাকে। ২০১০-এ মিশর অনূর্ধ্ব-২০ দলের জার্সি গায়ে অভিষেক মোহাম্মদ সালাহর। তবে দলে প্রথম পছন্দের লেফট-ব্যাক ছিলেন তিনি। তবে কঠোর পরিশ্রম, সামর্থ্য ও বাঁ-পায়ের দক্ষতা নিয়ে ক্রমেই নিজেকে আক্রমণভাগের একজন খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলেন মোহাম্মদ সালাহ। আর প্রচারবিমুখ ফুটবলার সালাহকে নিয়ে মিশরের ক্রীড়ালেখক মারওয়ান সাঈদ বলেন, সে খুবই বাস্তববাদী, শান্ত একজন ফুটবলার এবং মানুষ। দেশে বা মিশরের বাইরে বরং সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়েই চলে সে। সামাজিকমাধ্যম সে পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করে। খুব বেশি কথা বলা তার পছন্দ নয়। এটা ভালো কথা। আমরা অনেক তারকা খেলোয়াড়কেই টিভিতে কথা বলতে শুনি এবং সামাজিকমাধ্যমে এমন পোস্ট দিতে দেখি যা তাদের উচিত নয়। মো (সালাহ) তরুণ বয়সেই বিয়ে করেছে। তার এক কন্যা সন্তানও রয়েছে কিন্তু সে পারিবারিক জীবনকে স্পটলাইটের বাইরে রাখে। ১৯৯০’র পর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলছে মিশর। এতে প্রধান ভূমিকাটা তারই। মিশরে তার নামে নামকরণ হয়েছে স্কুল ও রাস্তা। মোহাম্মদ সালাহ মিশরের জন্য আল্লাহপ্রদত্ত উপহার স্বরূপ। ২০১২তে মিশর থেকে সুইজারল্যান্ডের এফসি বাসেলে পাড়ি দেন মোহাম্মদ সালাহ। ইউরোপে তার প্রথম গুরু বাসেল কোচ মুরাত ইয়াকিন বলেন, সালাহ খুবই নম্র ও বিনয়ী মানুষ। তবে খেলার মাঠে সে একজন বুদ্ধিদীপ্ত , আক্রমণাত্মক ফুটবলার। ২০১৩-১৪’র ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের গ্রুপ পর্বে কোচ হোসে মরিনহোর চেলসির বিপক্ষে দুই লেগে জয় দেখে বাসেল। দুই লেগেই গোল পান সালাহ। ২০১৩’র ইউয়েফা ইউরোপা লীগে কোয়ার্টার ফাইনালে সালাহর গোলে ইংলিশ টটেনহ্যামের বিপক্ষে জয়ী হয় বাসেল। আর বাসেলের কোচ ইয়াকিন বলেন, দ্বিতীয় লেগের আগেই আমি বলেছিলাম, এ ম্যাচে গোল পেলে সালাহকে আর দলে ধরে রাখতে পারবো না। ওই বছরই ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে সালাহকে কিনে নেয় চেলসি। সালাহর দিকে নজর ছিল লিভারপুলেরও। তবে চেলসির জার্সি গায়ে প্রিমিয়ার লীগে মাত্রই ১৩ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান মোহাম্মদ সালাহ। পরে টানা দুই মৌসুম সালাহকে ধারে খেলতে পাঠানো হয় ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনা ও এএস রোমায়। লিভারপুলে যোগ দেয়ার আগে রোমার জার্সি গায়ে ৮৩ ম্যাচে ৩৪ গোল পান সালাহ।
রাজধানী কায়রো থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরের নাগরিগ গ্রামের এক ক্রীড়াপ্রেমী পরিবারে জন্ম মোহাম্মদ সালাহর। তার পিতা ও চাচা ফুটবল খেলতেন নাগরিগ উয়ুথ ক্লাবে। সালাহর পিতা-মাতা দুজনেই সরকারি চাকরি করেন। এছাড়া সুগন্ধী ফুলের ব্যবসা রয়েছে তাদের। মিশরের নাগরিগ গ্রামে প্রধান ফসলও জেসমিন ফুল। যা পারফিউম তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। আট বছর বয়সে নাগরিগ ইয়ুথ সেন্টারে ফুটবল অনুশীলন শুরু করেন মোহাম্মদ। সম্প্রতি নাগরিগ ও বাসিউন ইয়ুথ সেন্টারের নামকরণ করা হয়েছে মোহাম্মদ সালাহর নামে। আর আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার মোহাম্মদ সালাহর ছেলেবেলার ফুটবল কোচ হামিদ আল সাদানি বলেন, সালাহর সাফল্যটা কেবল প্রতিভার কারণে নয়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্পের ফসল এখনকার মোহাম্মদ সালাহ। ১৪ বছর বয়সে অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা গাড়িতে কাটাতে হতো তার। সে খুবই বিনয়ী। আট বছর বয়সে যেমন ছিল এখনো তেমনই আছে সে।
পরিসংখ্যানে মোহাম্মদ সালাহ
চলতি প্রিমিয়ার লীগে সালাহ বাকিদের সঙ্গে তুলনা
গোল: ২২ হ্যারি কেইনের (২৩) পেছনে দ্বিতীয়
মোট শট: ১০০ কেইনের (১৪৬) পেছনে দ্বিতীয়
অনটার্গেটে শট: ৪৮ কেইনের (৬০) পেছনে দ্বিতীয়
বাঁ-পায়ে গোল: ১৯ শীর্ষে
ম্যাচে দুই বা বেশি গোল: ৫ কেইনের (৬) পেছনে দ্বিতীয়
মিনিট প্রতি গোল: ৯২.৭১ শীর্ষে (এক গোল পাওয়াদের বাদে)
অ্যাসিস্ট: ৭ যৌথ নবম (ডি ব্রুইনা সর্বাধিক ১৪)
সুযোগ তৈরি: ৪১ ১৪তম (ডি ব্রুইনা সর্বাধিক ৭৮)
সফল ড্রিবল: ৬৩ যৌথ তৃতীয় (হ্যাজার্ড সর্বাধিক ১১১)
প্রতিপক্ষ বক্সে টাচ: ১৮৫ দ্বিতীয় (রাহিম স্টারলিং সর্বাধিক ১৯০)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status