প্রথম পাতা

মুফতি ইজহারের জায়গা হচ্ছে না ২০ দলে

কাফি কামাল

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলে জায়গা হচ্ছে না মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেজামে ইসলাম পার্টির। রাজনীতিতে কট্টরপন্থার চর্চা, বারবার পক্ষবদলসহ জঙ্গিবাদের অভিযোগের কারণে মুফতি ইজহারের দলটিকে জোটে যুক্ত না করার  নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০ দল। প্রগতি, গণতন্ত্র ও ইসলামী মূল্যবোধের সমন্বয়ে একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি। জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দলটি রয়েছে নানামুখী সমালোচনার মুখে। জাতীয় ইস্যুতে মানসিক ঐক্য পোষণ করলেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করায় দেশের বাম ও মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক দলগুলো সাড়া দিচ্ছিল না বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এব্যাপারে। আর বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি কদম ফেলছে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে মুফতি ইজহারের মতো কট্টরপন্থি নেতাকে জোটে ভিড়িয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও বৃহত্তর ঐক্যের প্রক্রিয়ায় জল ঢালতে চায় না বিএনপিসহ ২০ দল। নেতারা বলছেন, জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামের জোটে থাকা না থাকা নিয়ে যখন সবখানে গুঞ্জন চলছে তখন নেজামে ইসলামের মতো কট্টরপন্থি, অনিবন্ধিত ও বিতর্কিত দলকে জোটে যুক্ত করা চরম আত্মঘাতী। নেতাদের কেউ কেউ আশঙ্কা করে বলছেন, হেফাজতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে আওয়ামী লীগের। মুফতি ইজহারের সঙ্গেও এক সময় ক্ষমতাসীন দলটির যোগাযোগ ছিল। তাই এমনটি ভাবা নিশ্চয়ই অমূলক হবে না যে, ২০ দলে যুক্ত হতে চাওয়ার পেছনে তার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। জোট ভাঙা বা সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির দিকে প্রগতিশীল দলগুলোর এগোনোর পথ রুখতেই মুফতি ইজহারকে ব্যবহার করতে পারে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে কর্মসূচিকেন্দ্রিক বৃহত্তর ঐক্যের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপিসহ ২০ দল। সে লক্ষ্যে সরকারের বাইরে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছেন বিএনপি ও ২০ দলের নেতারা। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন জোটের কয়েকটি শরিক দলের সঙ্গেও সূত্রপাত ঘটেছে আলোচনার। বৃহত্তর এ ঐক্যকে জনজোট বা জোটের প্ল্যাটফরমের আদল দিতে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবী নেতা। প্রাথমিকভাবে সবদিক থেকে মিলছে ইতিবাচক সাড়া। দলটির দায়িত্বশীল কয়েক নেতা জানান, বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের সূত্র ধরে কিছুদিন ধরে যোগাযোগ শুরু করেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারই একটি মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলামী পার্টি। নেজামে ইসলাম পার্টিকে জোটে যুক্ত করতে দূতিয়ালী করছিলেন বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান। কিন্তু মুফতি ইজহারের ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অনাগ্রহ থাকলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ২০ দলের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোটের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ২৮শে জানুয়ারির বৈঠকে পরিষ্কারভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাক ও নেজামে ইসলাম পার্টির (একাংশ) সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব অ্যাডভোকেট। কয়েকটি শরিক দলের নেতারাও তাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। ওইদিন মুফতি ইজহার বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে গেলেও পরে তাকে কৌশলে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
নেতারা জানান, বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০ দলের। সে চারদলের শরিক শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন মুফতি ইজহারুল ইসলাম। ২০০১ সালে জোট সরকার গঠিত হওয়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙে গেলে মুফতি আমিনীর নেতৃত্বাধীন অংশের মহাসচিব হন তিনি। পরে নিজেই চেয়ারম্যান হয়ে যান ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে অংশ নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং ওয়ান ইলেভেনের সময় জোট সরকারের কঠোর সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হন। রাজনীতিতে এমন বিরোধিতার পরও বিশেষ পরিস্থিতিতে ঐক্য করা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত জঙ্গিবাদের অভিযোগ কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছেন না বিএনপি ও ২০ দলের নেতারা। মুফতি ইজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভারত ও পাকিস্তানভিত্তিক কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তার। দেশের আলোচিত-সমালোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীরও তিনি। উল্লেখ্য, মুফতি ইজহারের ছেলে মুফতি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল ২০০৯ সালের ৫ই নভেম্বর মার্কিন দূতাবাসে হামলা পরিকল্পনার। ২০০৯ সালে রাউজান রাবার বাগান গোদারপাড় এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় হুজির প্রশিক্ষণকালে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক উদ্ধার করে এবং এ ঘটনায় দায়ের দুটি মামলার আসামি তালিকায় রয়েছে মুফতি ইজহারের নাম। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হুজির ৫ সদস্যকে নিজ দলের কর্মী দাবি করে সংবাদ সম্মেলনের পরদিন ২০১০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জঙ্গি মদতদানের অভিযোগে মুফতি ইজহারকেও গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। নানা সময়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লালখান বাজারে পাহাড়ের পাদদেশে মুফতি ইজাহারের পরিচালনাধীন জমি’আতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা ঘিরে গড়ে উঠেছিল আন্তঃদেশীয় জঙ্গিদের ঘাঁটি। ২০১৩ সালের ১০ই জুলাই চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদরাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে এবং এতে তিনজন নিহত হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওই বছরের অক্টোবরে ইজহারপুত্র মুফতি হারুন গ্রেপ্তার হন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশিক্ষণ সম্পাদক মুফতি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার। দুই বছর পালিয়ে থাকার পর একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন মুফতি ইজহার। গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দারা তাকে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে এলে ভি-চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মহাজোটের প্রতিষ্ঠাতা।’ বর্তমানে তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ও হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন।
বিএনপি ও ২০ দলের নেতারা জানান, বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলায় সাজার রায় ঘোষণার পর তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপ সত্ত্বেও রাজপথে উত্তাপ সৃষ্টিকারী কর্মসূচির দিকে যায়নি বিএনপি। বিএনপির প্রতিবাদের এ শান্তিপূর্ণ ধরন প্রশংসা কুড়িয়েছে সব মহলের। খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতি ও বিএনপির প্রতি জনসমর্থনের পারদ এখন ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম পার্টিকে ২০দলীয় জোটে আনলে তা হবে আত্মঘাতী ও রাজনৈতিক দেওলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ। কারণ এ দলটিকে জোটে যুক্ত করা হলে বিএনপিকে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়ও গ্রহণ করতে হবে। এতে বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলো বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আন্তর্জাতিক মহলের ন্যূনতম সমর্থনটুকুও ঝুঁকির মুখে পড়বে। যা প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত করবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status