প্রথম পাতা

মানবজমিন-এর একুশে পা

শামীমুল হক

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

নানা উত্থান-পতন। নাটকীয়তায় ঠাসা প্রথম সকাল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রঙিন ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন  পাঠকের হাতে হাতে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি খবর দিল ঢাকায় একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। সারা দেশ থেকে খবর আসছে বেলা দশটার মধ্যে পত্রিকা শেষ। কোথাও কোথাও পত্রিকা নিয়ে কাড়াকাড়ি। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি। এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিক নিয়ে পশ্চিমা ধাঁচের ট্যাবলয়েড পত্রিকা পাঠক কিভাবে নেয়? তা নিয়ে ছিল নানা শঙ্কা। প্রথম দিনেই সেই শঙ্কা মিইয়ে যায়। দেশজুড়ে আলোচনায় মানবজমিন। পত্রিকা প্রকাশেও রয়েছে এক ইতিহাস। একদিনেই বেকার ছিয়াত্তরজন সাংবাদিক, কর্মচারী। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তেজগাঁও থেকে তারা সোজা আশ্রয় নেন বাংলামটর। তাদের সামনে আদর্শ মতিউর রহমান চৌধুরী। মানবজমিন পত্রিকার প্রথম বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান সহকর্মীদের নিয়ে ওয়ালসো টাওয়ারের নিচে আড্ডা দেন। সবার সামনেই অন্ধকার। চাকরিহারা এসব সাংবাদিক এখন কি করবেন? কোথায় চাকরি পাবেন? আড্ডায় আড্ডায় পেরিয়ে যায় এক মাস। হঠাৎ একদিন সহকর্মীদের ডাকলেন আহমেদ ফারুক হাসান। বললেন, সবার বেতন নিয়ে যান। জানালেন, আপনাদের নিয়ে ভাবছেন মতি ভাই। সবার মাঝে দেখা দেয় আশার আলো। শুরুটা কাকতালীয়। নাটকীয়ও বটে। জুয়া খেলার মতো। ট্যাবলয়েড পত্রিকা কিভাবে নেবে পাঠক? নানা আলোচনা। জল্পনা, কল্পনা। ১৯৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি আলোর মুখ দেখে মানবজমিন। প্রথম দিনেই ক্লিক। মাঝে অনেক ইতিহাস। অনেক ঝড় ঝাপটা পেরুতে হয়েছে। আজ দৈনিক মানবজমিন একুশ বছরে পা রেখেছে। বিশটি বছর পেরিয়েছে। এ দুই দশকে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে পত্রিকাটি। জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সংবাদ ও তথ্যের প্রতি সত্যনিষ্ঠায় অবিচল দেশের প্রথম ও একমাত্র ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন-এর গৌরবময় ও ঐতিহাসিক এ মাহেন্দ্রক্ষণে সকলের প্রতি অফুরান শুভেচ্ছা। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দোলাচলে ভরা বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও সত্যের সন্ধানে নিত্য লড়াই করে যাচ্ছে মানবজমিন। এ সময়ে জাতীয় স্বার্থ আর গণমানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিল সবসময়। ফেলে আসা দিনগুলোতে চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে পরিবর্তিত বিশ্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা কিছু সত্য, সুন্দর, ভালো, মহৎ ও কল্যাণকর এবং দেশ ও জনগণের জন্য ইতিবাচক, সেসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় বিধানের কঠিন কাজটি সফলভাবে করেছে। ‘কারও তাঁবেদারি করে না’ এ স্লোগানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে শত চাপ ও বিরোধিতার মধ্যেও মানবজমিন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেছে। সত্য-সুন্দরকে আঁকড়ে ধরেছে। প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী নীতিতে অটল থেকেছেন এ সময়ে। দীর্ঘ সময়ে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত মোকাবিলা করেছেন সাহসের সঙ্গে। সহকর্মীদের প্রতি তাদের ভালোবাসা অপরিসীম। কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়। সত্যকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারীদের সাহস বাড়িয়েছে। আর তা করতে গিয়ে মানবজমিন অফিসে হামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং এক বিচারপতির টেলিফোন সংলাপ নিয়ে ক্যাসেট কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশ ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, নারী, প্রযুক্তি, ফ্যাশন, আন্তর্জাতিক বিষয়সহ জীবনের সকল অঙ্গনকে স্পর্শ করেছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যতায়। নতুন মুখের মাধ্যমে জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা উপহার দিয়েছে মানবজমিন। খেলাকে গুরুত্ব দিয়ে মানবজমিনই প্রথমবারের মতো শেষ পৃষ্ঠা বরাদ্দ রাখে খেলার পাতাকে। মানবজমিনই প্রথম প্রতিদিন বিনোদন পাতার প্রচলন শুরু করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সবসময়ের কঠিন সঙ্কুলতার প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়ে পাঠক আর সংবাদের মধ্যে সংযোগসূত্র হয়ে নিত্য উপস্থিত থেকেছে মুদ্রিত পাতায়। আর অনলাইনের মাধ্যমে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা সংবাদ নিয়ে হাজির থাকছে পাঠকের সঙ্গে। প্রকৃত সংবাদ আর সংবাদের পেছনের অন্তর্নিহিত সত্যই পূর্ণ করেছে মানবজমিন-এর প্রতিদিনের পৃষ্ঠাসমূহ। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের যাপিত জীবনের আশা ও দুঃখের কোনো বিষয়কেই উপেক্ষা করেনি মানবজমিন। পাঠকের জানার অধিকারকে পরিপুষ্ট করার প্রতিজ্ঞা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হয়নি। পেশাগত দায়বদ্ধতা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, কমিটমেন্ট দায়িত্বরূপে গ্রহণ করেছে। সত্য যত কঠিনই হোক, সেই কঠিনেরে ভালোবেসে মানবজমিন নিজেকে উপস্থাপন করেছে মানুষের চেতনা ও বিবেকের অঙ্গনে। পাঠককে প্রণোদিত করেছে বহুমুখী তথ্য ও সংবাদের ভিত্তিতে নিজের স্বাধীন ও স্বনির্ভর মতামত পরিগঠনে। পাঠকের মুক্তচিন্তা ও বাধাহীন-বিবেচনার ক্ষমতায়নকে মানবজমিন সব সময়ই শ্রদ্ধা করেছে বলেই কোনো বিশেষ দল-মত-গোষ্ঠী নয়, মানবজমিন হয়েছে সর্বস্তরের পাঠকের নিজস্ব দৈনিক। আস্থা, নির্ভরযোগ্যতা, পছন্দ ও বিশ্বাসের সংবাদমাধ্যম। সংকটে, সমস্যায় মানবজমিন আশা-জাগানিয়া স্পন্দনে মানুষকে দিতে চেয়েছে পথের দিশা। প্রতিদিন পাঠকের সামনে তথ্যের অধিকার নিয়ে অখণ্ডিত-সামগ্রিক চিন্তার সহযাত্রী হয়ে এসেছে।
একদল অভিজ্ঞ, সৎ, নির্লোভ এবং তরুণ-মেধাবী কর্মীকে নিয়ে স্বাপ্নিক-প্রতিষ্ঠাতা মতিউর রহমান চৌধুরীর উদ্যোগে বিকল্প সংবাদশক্তির উন্মেষের সেই রোমাঞ্চকর ঘটনা আজ ইতিহাসের অংশ। নানা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আজ অনলাইন এবং প্রিন্ট আকারে মানবজমিন জাতীয়, আন্তর্জাতিক বাংলাভাষী পাঠক সমাজে অন্যতম জনপ্রিয়-শীর্ষ দৈনিক। মানবজমিনকে এগিয়ে নিতে শুরু থেকে এর সহযাত্রী ছিলেন কলামনিস্ট, নাট্যকার আজিজ মিসির, কবি সাযযাদ কাদির, ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকের মনে জায়গা করে নেয়া কাজী আদর, প্রথম বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান। এ চারজনই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। এ ছাড়া ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের অনেক সহকর্মীকে হারিয়েছি আমরা। আজকের এ দিনে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, শহিদুল আজম, মিলান ফারাবি, মুজাহিদ আনসারি, মনোয়ার হোসেন, জাহিদ চৌধুরী, কাজী হাফিজ, সারোয়ার হোসেন, কবি সরকার আমিন, শাহনাজ মুন্নী, ইকবাল করিম নিশান, কেরামত উল্লাহ বিপ্লবসহ দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করছেন এমন শতাধিক সাংবাদিক মানবজমিনের শুরু থেকে জড়িত ছিলেন। সহকর্মী হিসাবে ছিলেন, তোফায়েল আহমেদ, আশরাফুল নওশাদসহ অনেকেই। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বাবর আশরাফুল হক শুরু থেকেই রয়েছেন ছায়ার মতো। সবার অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর দিকনির্দেশনায় মানুষের সিক্ত-ভালোবাসা তথা পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসের শক্তিতেই এগিয়ে চলছে মানবজমিন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি জন্মের ক্ষণে বসন্তের ফাল্গুনী সুর-ছন্দ-রঙ আর ভালোবাসার বন্ধনে একুশ বছরে পা দেয়ার এ দিনে সবার প্রতি বিনম্র ভালোবাসা। রইল শুভাশিস ও কৃতজ্ঞতা।  প্রত্যাশা জানাচ্ছি সম্মিলিত পথচলার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status