বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (২৬)

‘মাঝে মাঝে শুধু গৌরীর মুখটা আমাকে সজীব করে রাখত’

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৪:২৮ পূর্বাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমার অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-

আমার তখন রীতিমতো টলমল অবস্থা। একটা দুরন্ত সংকটময় ক্ষণে আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি।
নিজেকে ঠিকমতো প্রস্তুত করে সরাসরি হাজির হলাম গৌরীর বাবার সামনে। হয় উত্থান নতুবা পতন এমন একটা দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমি তাকে সব কথাই খুলে বললাম। অনেক বাকবিত-ার পর ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলেন। রাজি হলেন গৌরীর বাবা।
সেই মুহূর্তে আমার জীবনের ওপর থেকে এক নতুন দিনের বাতাস যেন খেলা করে গেল। আনন্দ-খুশিতে দু’জনেই ভরে গেলাম। বাড়ি ফিরে এসে এবার আমার বাবা-মাকে রাজি করাবার পালা। ওঁরা রাজি হলেন।
অনেক দূর ব্যবধানে দুটো বাড়ি! দুটো বাড়ির দুটো মনে এক নতুন আশার দোলা! দুটো মন যেন সর্বক্ষণ পাশাপাশি। আমি তখন অসম্ভব রকমের হালকা। সব কাজেই যেন আমি সহজেই মন বসাতে পারছি। আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি হতে থাকল।
ঠিক এমন সময় শুনলাম ‘কামনা’ নামে একটা ছবি তৈরি হবে। অল্প খরচের ছবি।
নবেন্দুসুন্দর ব্যানার্জি হলেন ছবির পরিচালক। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। একরাশ আনন্দ নিয়ে আমি দেখা করতে গেলাম যথাসময়ে।
সুযোগ পেলাম ‘কামনা’ ছবিতে অভিনয় করার। চরমতম সুযোগ। মনে হলো সুপ্রসন্ন হয়েছেন বোধ হয় ভাগ্যদেবতা।
সেদিন আবার সেই মুহূর্তে আমি যেন আমার মনের পর্দায় দেখতে পেলাম মামাকে। বড়মামার সেই বাণী যেন আমাকে আবার অনুপ্রাণিত করল।
নবেন্দুবাবু আমাকে ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দিলেন। স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার আর এক নতুন সোপানে এসে দাঁড়ালাম।
ছবির কাজ শুরু হলো। আমার পারিশ্রমিক ঠিক হলো এক হাজার পাঁচশ টাকা। ইতোমধ্যে গৌরী আমার হয়েছে। একান্ত আমারই। সে কথায় পরে আসছি।
অফিস পালিয়ে, অফিস ছুটি নিয়ে আমি ‘কামনা’ ছবির কাজ শেষ করলাম। আমার ভিতরকার মানুষটা তখন মহা আনন্দে-খুশিতে ভরপুর। আমি যেন আমার অনেক স্বপ্নে-ভরা তরীখানা অনেক ঢেউ পেছনে রেখে একটু একটু করে তীরের দিকে নিয়ে চলেছি। আমি যেন আমার সেই ছোট্ট আশার তরীতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমার সাফল্যের মোহনা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমাকে ঘিরে যে প্রচ- ঝড়ের তা-ব চলছিল, মনে হলো যেন তার গতিবেগ স্তিমিত হয়ে আসছে। আমি যেন বাঁচার আলোর নিশান দেখতে পাচ্ছি।
‘কামনা’ মুক্তি পেল। মুক্তি পেল ১৯৪৯ সালে!
এই ১৯৪৯ সালেই ভারতীয় চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল। এই সালে ভারত সরকার ফিল্ম এনকোয়ারি কমিটি তৈরি করলেন। আবার এই সালেই কাহিনিচিত্রের দৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ করে এগারো হাজার ফুট করার ব্যাপারটা পাকা হয়। আর ট্রেলারের দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট হলো চারশো ফুট।
এমন সময় আমার স্বপ্নের তরীখানা যেন সহসা অস্বাভাবিকভাবে দুলে উঠল। আমার মনে তখন ভয়ঙ্কর ভয়! এই এবারই হয়তো আমার ডুবে যাবার-তলিয়ে যাবার লগ্ন সমাগত, সেই আশঙ্কা।
‘দৃষ্টিদান’ ইতোমধ্যেই মুক্তি পেয়েছিল। মুক্তি পেয়েছিল বটে তবে চরমতম ব্যর্থ হয়েছিল ব্যবসায়িক দিক থেকে। অনেক আশা ছিল কামনা’কে নিয়ে। ছবির জনপ্রিয়তা মানেই তো আমার স্থায়িত্ব। হলো না। শুনলাম কামনা’ও নাকি দর্শকরা নিচ্ছেন না। ছবিটা মার খেয়েছে।
আমি মনে মনে ‘কামনা’ ছবির সাফল্য কামনা করেছিলাম। বারকতক ঈশ্বরকেও স্মরণ করেছিলাম। আমার স্বার্থপ্রণোদিত সেই কামনা বোধ করি ঈশ্বর উপেক্ষা করলেন।
‘কামনা’ ফ্লপ করল। ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। আমার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লোভ যেন খতম হয়ে যাবার মুখে। একবার আশা আবার নিরাশা, একবার উত্থান পুনরায় পতন যেন আমাকে ক্লান্ত করে তুলল। স্থির করলাম যত ব্যর্থতাই আসুক না কেন, আমি হাসিমুখে তা বরণ করে নেব।
আবার কেরানির জীবন শুরু করে দিলাম। আবার অফিস-আবার অফিস থেকে বাড়ি ফেরা।
মাঝে মাঝে শুধু গৌরীর মুখটা আমাকে সজীব করে রাখত।
এসব কথা ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিককার।
বিয়ের তারিখ তখন মোটামুটিভাবে স্থির হয়ে গেছে। তবুও অনেকগুলো দিন পেরিয়ে তবেই আসবে সেই শুভলগ্ন।
অফিসে কাজ করছি। কী ভাবে যেন আমি সরোজবাবুর কথা শুনলাম তা মনে করতে পারছি না। সরোজ মুখার্জি। শুনলাম সরোজবাবু ‘মর্যাদা’ নামে একটা ছবি তৈরি করার পরিকল্পনা প্রায় কার্যকরী করে তুলেছেন। খবরটা আমার কানে আসতে আবার কেমন যেন চঞ্চল হয়ে পড়লাম। তখন একমাত্র ভাবনা সরোজবাবুর কাছে কী ভাবে আমার আকাক্সক্ষার কথা বলব।
শুধু ভাবছিÑ আমি শুধু ভাবছি। ওদিকে সরোজবাবু ছবির নায়ক স্থির করে ফেলেছেন। নায়ক প্রদীপকুমার।
প্রদীপকুমার তো মোটামুটিভাবে জনপ্রিয়, প্রতিষ্ঠিত নায়ক।
প্রদীপকুমারকে আমরা শেতলদা বলে ডাকতাম। এক সঙ্গে থিয়েটারও করেছি। সে কথা আগেই তো বলেছি।
সেই প্রদীপকুমার এই ছবির নায়ক মনোনীত হয়েছেন শুনে আমার উৎসাহ স্তিমিত হয়ে গেল। তবুও সরোজবাবুর ছবিতে অভিনয় করার ইচ্ছে একেবারে বর্জন করতে পারলাম না। নাই বা পেলাম নায়কের মর্যাদা!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status