মত-মতান্তর

একাত্তর: আগে-পরে(১৮)

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘সভাপতি হলে তুই মাত করে দিবি’

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:৩৬ পূর্বাহ্ন

ছাত্রলীগ সম্মেলন নিয়ে টান টান উত্তেজনা বরাবরই ছিল। যেমনটা এখনও বলবৎ। তবে স্বাধীনতা পূর্ব ছাত্রলীগ যে ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ধারক ছিল তা বর্ণনাতীত। একবার কমিটি গঠন করা হলে দেখা যায়, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দু’জই কারারুদ্ধ। পরে তা বদল হয়। আরেকবার যে কমিটি গঠিত হয় তাতে বিভক্তি ছিল মারাত্মক পর্যায়ের। পরে আবারও মাঝামাঝি সময়ে সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। সেসব নাটকীয়তা নিয়ে নূরে আলম সিদ্দিকীর ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার-এর আজ পড়ুন ১৮তম কিস্তি
:
আমার জীবনের সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নটি ছিল ছাত্রলীগ সভাপতি হওয়া। কারারুদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রামের মান্নান ভাই সভাপতি এবং আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এটি আমার কাছে এক লাফে মগডালে ওঠার মতোই বিস্ময়কর ব্যাপার। আমি জেলহাজতে এসে খবরটা জেনে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। কারাগারে ফেরত গিয়ে বসের কাছে যখন খবরটি দিলাম তখন তিনি ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়তে লাগলেন। মুখে বলেছিলেন, না না, এটা মোটেও ঠিক হবে না। সংগঠনের এই দুর্দিনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুজনই কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকলে দল অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়বে। আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসের পাশের সেলে আর মান্নান ভাই চট্টগ্রাম কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলেন। আমার সাধারণ সম্পাদক হওয়া হলো না তবুও প্রসন্ন, ঋষ্টচিত্তে মুজিব ভাইয়ের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরে চিরকুট পাঠালাম বাকী ভাইয়ের কাছে। পরের দিন আমার মামলার তারিখ ছিল, ওখানে গিয়ে বললাম বসের নির্দেশ কারাবন্দি দু’জন একসঙ্গে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে পারে না। বসের অভিব্যক্তি তাই। তাহলে সাংগঠনিক তৎপরতা অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। তখন সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা, আদর্শের প্রতি আনুগত্য এবং স্বদেশের মুক্তি কামনায় হৃদয় এতটাই আবেগ আপ্লুত ছিল যে, প্রাপ্তি-প্রত্যাশার একটা প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষাতো থাকতেই পারে; তা সত্ত্বেও সার্বিক যুক্তিতে যেটি প্রয়োজন হতো, সেটিকে গ্রহণ করতে দ্বিধা হতো না। বলা যায়, চিত্ত নিঃশঙ্ক থাকতো তাই আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বসের দেয়া সিদ্ধান্তটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে পেরেছিলাম এবং পরের দিন কোর্টহাজতে সংবাদটি পৌঁছে দিতে আমার তেমন কোনো কষ্ট হয়নি। আজকের প্রজন্মের কাছে এটা আষাঢ়ে গল্প মনে হলেও আসলেই এটাই বাস্তব। তখনকার সময়ে এধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ মারাত্মক কঠিন কিছু ছিল না। আমাদের ফেরদৌস কোরেশী ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার বক্তৃতা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, রেসকোর্স বা পল্টন ময়দানের প্রান্তিক জনতার চিত্ত আকর্ষণ বা তাদের উদ্দীপ্ত, উদ্বেলিত করার মতো আবেগ আপ্লুত ও উচ্ছ্বসিত হৃদয়ের আবির মাখা ছিল না বটে তবে নিঃসন্দেহে জ্ঞানগর্ভ ছিল। নির্দিষ্ট কর্মিসভায় তিনি তার বক্তৃতায় প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করতে পারতেন। তবে তারও একটা নির্ধারিত শ্রোতামণ্ডলী থাকতে হতো। তবে সার্বিকভাবে সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য তার বক্তৃতা তেমন ফলপ্রসূ ছিল না। শব্দচয়ন ও বাচনভঙ্গি নিছকই ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও তথ্যভিত্তিক। আমাদের ছাত্রলীগের সভাপতিদের মধ্যে বাকী ভাই স্বভাবসুলভভাবেই বক্তৃতা বিমুখ ছিলেন। সিরাজুল আলম খান ভাইও জনসভায় বক্তৃতা করতে চাইতেন না। কিন্তু কর্মিসভায় বাপরে বাপ আমি বক্তৃতা করা ঘৃণা করি বলে শুরু করে প্রায় দেড়, দুই ঘণ্টা ধরে তিনি তাত্ত্বিক বুলি কবচাতেন। সাধারণ নেতাকর্মী তো বটেই আমরা যারা পড়ুয়া ছাত্রনেতা বা কর্মী ছিলাম তাদেরও বিরক্ত সাধিত হতো। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমার জানা মতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন রক্তের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি করতে পারতেন এবং তার বক্তৃতা শ্রোতাদের মধ্যে একটা উন্মাদনা তৈরি করতো। যদিও ভাষায়, শব্দচয়নে তিনি খুব একটা আলঙ্করিক ছিলেন না। যেমন তার ভাষণে তিনি বলতেন, আমাদের দাবি গ্রহণ না করা হলে টেলিফোনের তার কেটে দেব; রেলের লাইন উপড়ে দেব; সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিকল করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেব। তখনকার দিনে এ সমস্ত কথা উচ্চারণ করা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিকতা ছিল। বক্তৃতায় তিনি প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ছিলেন। ওবায়েদ ভাই বাগ্মি ছিলেন না তবুও চেহারা-সুরত, কণ্ঠ মিলিয়ে বক্তৃতা করলে স্রোতা ধরে রাখতে পারতেন। আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ধারায় সর্বজনাব আতাউর রহমান খান ও অলি আহাদ সাহেবের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় লীগের সমর্থনে ছাত্রলীগের একটি অংশকে টানার চেষ্টা করা হতো এবং এই প্রচেষ্টার পুরোধা ছিলেন ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর ছাত্রলীগের যে সম্মেলন হয়, সেখানে দুটি প্যানেল মোটামুটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটিতে আমাকে সভাপতি ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে সাধারণ সম্পাদক, অন্যটিতে তোফায়েল আহমেদকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে কাউন্সিলরগণ তৎপরত ছিল। তবে দ্বিতীয় প্যানেলটির সমর্থনে কাউন্সিলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। যেদিন কাউন্সিল অধিবেশন হবে ঠিক তার আগের দিন রাতে ওবায়েদ ভাই, এনায়েত ভাই, বাকি ভাইসহ আমরা অনেকে ধানমন্ডির ২৩ নম্বর রোডে মানিক ভাইয়ের (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা) বাসায় উপস্থিত ছিলাম। তখন মানিক ভাই প্রয়াত। হঠাৎ করে খবর পেলাম সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাশে রুচিতা নামের একটি শরীরচর্চা কেন্দ্র ছিল (ক্লাব থেকে কয়েকবার মিস্টার পূর্ব পাকিস্তান নির্বাচিত হয়েছিল)। এ ক্লাবের সব সদস্যই ছাত্রলীগকে সমর্থন করতেন কীভাবে জানি না। তবে লক্ষ্যণীয় ছিল রুচিতা ক্লাবের প্রায় সব সদস্যই ফেরদৌস ভাইয়ের প্রতি অনুগত ছিলেন। নির্বাচনী কাউন্সিলের আগের রাতে তারা ৩২ নম্বরে দুটো জিপ নিয়ে উপস্থিত হয়ে কিছুক্ষণ রাজনৈতিক স্লোগান দিতে থাকেন। মুজিব ভাই স্লোগান শুনে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালে ওই জিপ দুটি থেকে আমার পক্ষে স্লোগান দিয়ে মুজিব ভাইকে গালিগালাজ করা হয়। এর পুরোটাই ফেরদৌস ভাইয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। মানিক ভাইয়ের বাসায় বসে যখন খবরটি শুনলাম তখন সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি তো অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। বাকি ভাই জোরে জোরে ও উচ্চকণ্ঠে বলছিলেন ফেরদৌস কোরেশী এ রকম একটা নাশকতা করলো আগে কিছুই টের পেলাম না। আমাদের অন্য নেতারাও খুবই উদ্বিগ্ন এবং অস্থির হয়ে উঠলেন। তাদের সবাইকেই নিদারুণ অসহায় মনে হচ্ছিল।
বঙ্গবন্ধু এতটাই ক্ষিপ্ত, বিক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হয়েছিলেন যে, নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এলাকায় আমার সমর্থনে কোনো ছাত্রলীগ কর্মী বা নেতা যেন প্রবেশ করতে না পারে, আমিতো নই-ই। আমার জানা মতে, মুজিব ভাই কোনো বিষয়ে এতটা ক্রোধান্বিত হননি। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে প্রবেশ করাতো দূরে থাক ওই এলাকাজুড়ে আমাদের কেউ এলে হয়তো গুলি খেতে হতো কারণ খসরু (ওরা এগারোজনের নায়ক খসরু চৌধুরী), মন্টু (গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু), সেলিম (মোস্তফা মহসীন মন্টুর বড় ভাই, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা) তিনজনই থ্রি নট থ্রিসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সোলে সিনেমার গাব্বার খানের মতো পায়চারী করছিলেন। সঙ্গে আমার গুষ্টি উদ্ধার। রুচিতা ক্লাবের সদস্য তৎকালীন মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান তরুণ, ইলাহী, বুড্ডা, কালু তারা শুনেছি তাদের মতো সুসজ্জিত হয়ে রওনা দিয়েছিল। আল্লাহর শুকর পুলিশ বৈদেশিক মন্ত্রণালয় বর্তমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে থেকে তাদের গতিরোধ করে এবং ফিরে যেতে বাধ্য করে; নইলে হয়তো বা অনেক রক্তারক্তি হতো এবং বাংলার ছাত্রলীগ গঠনের পরিকল্পনাটিও ফলপ্রসূভাবে কার্যকর হতো। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিল না তবুও হোন্ডাবাহিনীর মাধ্যমে প্রতিটি খবরই আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল। ওবায়েদ ভাই (ওবায়দুর রহমান), বাকী ভাই পুলিশ কর্তৃক ওদের গতিরোধ করার কারণে অনেকটা স্বস্তি পেলেন। সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) সুকৌশলে আ স ম রবের নামটি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সংযুক্ত করে তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে একতরফাভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করিয়ে নিলেন। এই ঘটনাটি ইত্তেফাকে বর্ণনা করে সংবাদ পরিবেশিত হয় এবং শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেন (যার সঙ্গে মুজিব ভাইয়ের তুমি তুমি সম্পর্ক ছিল) খুব সম্ভবত টেলিফোনে আদ্যোপান্ত ঘটনাটি মুজিব ভাইকে অবহিত করেন। মুজিব ভাই সম্পূর্ণ অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে তিনি তার বাসায় সবাইকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। কেন্দ্রীয় সম্মেলনে এলে জেলাপর্যায়ের প্রায় সব নেতাই ঢাকায় দু-চারদিন অবস্থান করতেন। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলতে চাই আমি ক্ষণিকের জন্য ভুল বোঝাবুঝির শিকার হলেও বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলাম এবং মুজিব নেওটা ছিলাম। কারাগারে অবরুদ্ধ থাকাকালেই আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন তুই সভাপতি হবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হবি না। সাধারণ সম্পাদকের অনেক দাপ্তরিক কাজ আছে যেটা করা তোর জন্য দুঃসাধ্য হবে। তোর বক্তৃতা করার দক্ষতা আছে সভাপতি হলে তুই মাত করে দিতে পারবি। এটা ওই সম্মেলনের কাছাকাছি সময়ের পরামর্শ না হলেও কথাটি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। ভণ্ডুল হওয়া সম্মেলনে একতরফা ছাত্রলীগের প্যানেলটি গঠিত হলেও ইত্তেফাকের পরিবেশিত সংবাদ ও নানাবিধ সোর্স হতে বঙ্গবন্ধু বাস্তবটা অনেকখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই জেলা নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রের তখনকার দিনের সাবেক ও সমকালীন নেতৃবৃন্দকে ডেকে বিষয়টি সরাসরি শুনতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সমবেত হয়ে নতুন কমিটি গঠনের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাদের মধ্য থেকে তার বিরোধিতা করে বলা হয় এতে সংকট বাড়বে এবং সংগঠনের বিভক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। কোনো অবস্থাতেই সংগঠনের বিভক্তি আমার কাম্য ছিল না তাতে ছাত্রলীগ থেকে বিতাড়িত হলেও না। ঠিক হলো সেপ্টেম্বরের দিকে আরেকটি সম্মেলন হবে অনেক জাঁকজমকভাবে তবে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নেতা ও কর্মীরা সমবেত হবেন যেখানে তোফায়েল আহমদ ও আমি একসঙ্গে বক্তৃতা করবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status