মিডিয়া কর্নার

ইয়ে আফ্ সার তো জানতা

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:১৫ পূর্বাহ্ন

প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের দেখা বহুল বঠিত গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’। বইটির ১০ম অধ্যায় ‘ইয়ে আফ্ সার তো জানতা’:

রাজনৈতিক সরকার কোন কিছু ইচ্ছে করলেই তা ঘটবে; বা অনিচ্ছায় যে তা ঘটবে না, তার এমন কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। শুধু রাজনৈতিক কেন অন্য ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য। একুশেতে গুলি হবে, এমন একটা আশঙ্কা আন্দোলনকারীদের মধ্যে থাকলেও সরকারের সিদ্ধান্ত গুলি করার পক্ষে ছিল কিনা, সেটা আজ ত্রিশ বছর পরে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সন্ধানী ইতিহাসবেত্তাগণ অনুসন্ধান করছেন নিশ্চয়ই। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনকে এই গুলি করার দায় থেকে মুক্তিদানের প্রশ্নটা এখানে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও হিসেবে দেখার কথা উঠছে না। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর স্তিমিতপ্রায় বিক্ষোভের সময় ঢাকার এসপি অবাঙালী মাসুদ ছাত্র-জনতার উপর আকস্মিকভাবে গুলি করার নির্দেশ দিলেন কেন, সেই তথ্যটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। (সরকারী তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি গুলির অর্ডার দেননি।) এসপি মাসুদ কার নির্দেশে গুলি করেছিলেন? (প্রায় পঁচিশ বছর পরে এই মাসুদই ভুট্টোর রাজত্বকালে প্রমোশন পেয়ে গুপ্ত পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে ভুট্টোকে ফাঁসি দানের জন্যে পাকিস্তানের জেনারেল জিয়ার প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন।) তিনি যে সেদিন প্রাদেশিক সরকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে কোন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গুলি করেননি, সে কথা কি করে বলা যায়? এ সমস্ত প্রশ্ন আজকের নয়। সে সময়কার প্রাদেশিক সরকারের কোন সংশ্লিষ্ট দফতরেই গুলি করার নির্দেশসহ কোন তথ্য বা নথি নেই। মুখ্যমন্ত্রী জনাব আমীন মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রয়োজনে এবং চিরাচরিত নিয়ম মোতাবেক এই গুলিবর্ষণ বা হত্যাকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেননি। ‘রাষ্ট্রের শত্রুদের’ হত্যাটা যেন সে সময়ও যৌক্তিক ছিল। গুলির নির্দেশ তিনি বা ঢাকার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট জনাব কোরেশী দিয়েছেন বলে প্রমাণ নেই। এ সব জেনেও জনাব আমিন গুলিবর্ষণ ও হত্যার সব দায়িত্ব নিজের উপর নিয়েছিলেন মুসলিম লীগ রাজনীতিরচ প্রয়োজনে। সেদিন জনগণের শ্লোগান ছিল: মাসুদের ফাঁসি চাই।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ভাষা হরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শপথ ও জঙ্গী উত্তেজনা এবং পুলিশের আক্রমনের মুখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক ঘটনার সময় পূর্ব সিদ্ধান্ত থাকলে কর্তৃপক্ষ গুলির নির্দেশ দিতে পারতেন। কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের সকল কৌশলই গ্রহণ করলেনÑলাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, গ্রেফতার, গুলি নয়। বেলা বারোটার পর আমরা কেউ কেউ ভাবলাম, বিকেলে মুখোমুখি সংগ্রামের আশংকা কম। আমি ও আরো অনেকে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যেতে শুরু করলাম, বিকেলে ফিরব বলে। সকালের ঘটনার উপর লিফলেট লেখার জন্যেও কেউ কেউ নিযুক্ত হলেন। কিন্তু বিকেলে গুলির খবর এলো তড়িৎগতিতে আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে- ‘সংবাদ’ অফিসে। মুহূর্তের মধ্যে কক্ষটা শূন্য হয়ে গেল। আবুল হাসনাত (বর্তমানে জয়েন্ট লেবার ডাইরেক্টর) ও আমি আবার দৌড়ে চললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। শোকাভূত ঢাকা শহর তখন মেডিক্যাল কলেজের দিকে। সংবাদের সাব-এডিটর হাসনাত আন্দোলনকারীদের মধ্যে হারিয়ে গেল। সেখানে পেলাম আলোকচিত্রশিল্পী আমানুল হককে- যার সে সময়কার মূল্যবান আলোকচিত্র আজ আমাদের ইতিহাসের অংশ।
গুলির পূর্ব থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে শহরে ও ছাত্রবাসে কয়েকটি গোপন সেল গড়ে উঠেছিল- ভাষা আন্দোলন পরিচালনা ও প্রচারের উদ্দেশ্যে। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের একটা কক্ষে (ডা: আহমদ রফিকের- তখন ছাত্র) প্রধান ব্যক্তি ছিলেন পরবর্তীকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার। আত্মগোপনকারী এই রাজনীতিক মার্চের শেষে বা এপ্রিলের প্রথমদিকে গ্রেফতার হয়ে যান। আটচল্লিশ সালে কলকাতার পার্টি কংগ্রেসের সময় তাকে আরো কয়েকজনের সাথে ঢাকায় পাঠানো হয় প্রথমবারের ভাষা আন্দোলন অংশগ্রহণের জন্যে। পার্টি কংগ্রেসে তিনি ঢাকা থেকে কোলকাতা গিয়েছিলেন।
মাসুদের গুলির নির্দেশকে অনেকে আমলাতান্ত্রিক ধৃষ্টতা বলে ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু চরম উত্তেজনাপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিক্ষিপ্ত পরিস্থিতিতেও উচ্চ পদস্থ আমলা বা সরকারী কর্মকর্তাকে সংযম ও সুস্থ সিদ্ধান্ত নিতে দেখেছি। ঊনষাট সালের জানুয়ারীর গণ-আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ঐক্যবদ্ধ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-স্রোত যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমেছিল, তখন উপাচার্যের বাসার সম্মুখে যে কোন হঠকারী পুলিশ অফিসার ছাত্রদের উপর গুলি করার সুযোগ নিতে পারতেন। গভর্নর মোনায়েম খাঁন সরকার যেকোন পন্থায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ছাত্রদের স্তব্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেদিনই বিপ্লবী আসাদকে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এম, কে আনোয়ার (পরবর্তীকালে বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র সচিব) ও ঢাকার পুলিশ-প্রধান জনাব মামুন এক সাথে উপস্থিত হলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাঁরা কতিপয় অফিসার নিয়ে উপস্থিত থেকে ছিলেন উপাচার্যের বাসার সম্মুখে বৃক্ষের নীচে।
বিক্ষুব্ধ শ্লোগানমুখর ছাত্ররা ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমে গেছে। তারা পুলিশের অস্থায়ী কাঁটাতারের ব্যারিকেড সম্মুখে দিকে ঠেলে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল; শহীদ মিনারে উপস্থিত হওয়াই ছির কর্মসূচী। চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ হবার পর গুলি হবার আশংকা দেখা দিল। উপস্থিত রিপোর্টারগণ বিভিন্ন নিরাপদ অবস্থানে ছুটে গেলেন। আমি জনাব আনোয়ারও পুলিশ-প্রধান জনাব মামুনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ক’জন রিপোর্টার ভিড় ঠেলে তাদের কাছে উপস্থিত হলাম উৎকন্ঠা নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম: এ পরিস্থিতিতে কি গুলি হবে? দু’জনেই বলে উঠলেন: আমরা উপস্থিত রয়েছি গুলি না করার জন্যে- আমরা গুলি করব না। কিছুক্ষণ শ্লোগান ও পুলিশের সাথে মুখোমুখি হবার পর বাঁধ-ভাঙ্গা প্লাবনের মতো ছাত্র-স্রোত চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করে মিনারের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। কোন গুলি তারা সেদিন সে সময় করেননি, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। (এর মাশুল পরবর্তীকালে জনাব মামুনকে দিতে হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতেÑশহীদ হয়ে।) আমলাতান্ত্রিক ধৃষ্টতা প্রকাশের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেদিন তারা তা করেননি।
কিন্তু সেদিন পরবর্তী সময়ে আসাদকে হত্যা করেছিল জনৈক পুলিশ অফিসারই- কোনো এক দানবীয় শক্তির নির্দেশে।
বাইশে ফেব্রুয়ারী সমগ্র ঢাকা শহরটা রাস্তায় নেমেছিল প্রতিবাদমুখর হয়ে। শহরের বহুস্থানে গুলি হয়েছিল। সেদিন ছিল হরতাল-ধর্মঘট। সরকারের কড়া নির্দেশে সরকারী অফিসার ও কর্মচারিগণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন কোন অফিসে উপস্থিত হন। সরকারী অফিসে ধর্মঘট করানোর জন্যে কিছুসংখ্যক স্কোয়াড বিভিন্ন অফিসে প্রবেশ করে ফজলুল হক হলের সামনে আমার পাশেই ছিল শান্তি; ফরোয়ার্ড ব্লকের যুবক-কর্মী। আমাদের কে নির্দেশ দিল তা আর মনে নেই। এই দু’জনকে যেতে হবে সেগুনবাগিচাস্থ সিএনবি অফিসে অফিসারদের ধর্মঘটে উৎসাহিত করার জন্যে। তখনই একজন খবর নিয়ে এসেছিল সিএনবি অফিসে কাজ চলছে।
শান্তি ও আমি এক সাইকেলে চড়ে গেলাম রমনা পেট্রোল পাম্পের নিকটবর্তী (এককালে ইউরেকা) সিএনবি সেডে। (বর্তমানে বহুতল অট্টালিকা হচ্ছে)। লম্বা সেডের মধ্যে প্রবেশ করেই দু’যুবক দু’দিকে দাঁড়িয়ে সবাইকে আহ্বান জানালাম ধর্মঘটে যোগদান করতে। সবাই স্তব্ধ। একজন বললেন, পাশের কক্ষেই এসডিও সায়েব।
তার কক্ষেও একই আবেদন। তিনি বললেন: এরা সবাই চলে গেলে, আমি চলে যাব। তিনি যে ইঙ্গিত দিলেন, তা ছিল সবার কাছে স্পষ্ট। ধর্মঘট করানোর সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে আমরা যখন উক্ত অফিস থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় নামছি, তখন জনৈক সুশ্রী সাইকেল চালক পেছন থেকে এসে বললেন: আপনারা ধর্মঘট করিয়েছেন।
: হ্যাঁ।
ভদ্রলোক চট করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন: চলুন।
বুঝতে পারলাম ধরা পড়েছি আইবির হাতে। শান্তি ছিল আমার চাইতে বহুগুণ স্মার্ট ও সতর্ক। সে চট করে সাইকেলে চড়ে বলল: ওকে ছেড়ে দিন বলছি। না হলে উপায় নেই।
ভদ্রলোক নির্বিকার। আমাকে নিয়ে আজকের পররাষ্ট্র দফতরের সম্মুখবর্তী পথ দিয়ে হাঁটা ধরলেন। এক হাতে তার সাইকেল, আরেক হাতে আমি। জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা আমার। শান্তি আমাদের পাশ দিয়েই সাইকেলে ঘুটগুট করে বেড়াচ্ছে। আর আমি ধৃত। মাঝে মাঝে কাছে এসে সে বলছে: বলছি ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন। দাঁড়ান দেখাচ্ছি, ছাত্রদের নিয়ে আসছি।
আমাদের পাশাপাশি শান্তি চলল, ধমক দিতে দিতে। ভদ্রলোক এবার দাঁড়ালেন। বৃক্ষ ঘাতকরা যে বোগেনভেলিয়া গাছটা হত্যা করেছে, তার পূর্ব দিকের ফুটপাতে। আইবি অফিসার বললেন: এই হিন্দু ছেলেটার সাথে কেন রাজনীতি করছেন? আপনাকে থানায় নেব না, ছেড়ে দিচ্ছি। এ ভাষা আমারও। ওর সঙ্গ ছাড়ুন।
অল্প দূর থেকে শান্তি শুনছিল কথাগুলো। ছাড়া পেয়ে আবার শান্তির সাইকেলের পেছনে উঠে শান্তিতে ফজলুল হক হলের দিকে আবার যাত্রা করলাম। ভাষা-আন্দোলনের পরে শান্তির সাথে বিশেষ আর দেখা হয়নি।
তবে পরবর্তীকালে সেই আইবি অফিসার মাসুদ সায়েবের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ষাট সালে, জেল গেটে। আমি ছিলাম প্রথম মার্শাল ল আমলের বন্দী; তিনি ছিলেন জিজ্ঞাসাবাদের অফিসার।
জেলের নাজির জমাদার কক্ষ থেকে একদিন বিকেলে ডেকে আনল জেল গেটে; ফায়েজ সাহাব, আপকা আফিস কল হ্যায়।
ডেপুটি জেলরের কক্ষে এসে পেলাম সেই আট বছর পূর্বেকার আইবি অফিসার মাসুদ সায়েবকে। তিনি বললেন: আমাদের আসতে হয় জানতে, মনের পরিবর্তন হয়েছে কি না। আপনারা তো ‘নো’ বলে চলে যাচ্ছেন।
পরোক্ষভাবে তিনি নিরাপত্তা বন্দীর বন্ড দেবার বিরুদ্ধে মত দিলেন অথচ এ ছিল তার চাকরির নীতিমালার পরিপন্থী। আমি বললাম: আপনি জানেন, কারো হ্যাঁ বলার প্রশ্নই উঠে না। তবুও বারবার আসছেন। আচ্ছা বলুনতো, আপনিও কেন বন্ডের বিরুদ্ধে।
স্বল্প ও মৃদুভাষী আইবি অফিসার মাসুদ সায়েব বললেন: আমিই তো আপনাকে বলেছিলাম- এ ভাষা আমারও। দেশটাও।
নাজির জমাদার আমাকে কক্ষে নিয়ে যেতে যেতে বলল: ইয়ে আফসার তো জানতা। সব আদমী মানা কর দিয়া। তভ্ভি কিঁউ আতা।

[আগামীকাল পড়ুন বইটির একাদশ অধ্যায় ‘জেলখানার ভাত আমি খাব না’]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status