বই থেকে নেয়া

উত্তম কুমারের অজানা কথা (১৫)

‘ভাবলাম এবার যদি গৌরী আসে আমি তাকে গান শোনাবো’

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৪২ অপরাহ্ন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি  মহানায়ক উত্তম কুমার  অনন্য অভিনয় জাদুতে মুগ্ধতা বিলিয়েছেন দুর্নিবার। তার অভিনীত ছবি মানেই ভালোলাগার এক বিশাল প্রাপ্তি। পর্দায় এ নায়ক যেমন উজ্জ্বল তেমনই তার ব্যক্তিজীবনের চলাচলেও ছিল নানান রঙের মিশেল। সেই অজানা জীবনের গল্প তার বয়ান থেকে অনুলিখন করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ যা পরবর্তী সময়ে ‘আমার আমি’ নামে বই আকারে প্রকাশ হয়। সে বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে উত্তম কুমারের আত্মজীবনী-

ল্যান্সডাউন রোডের অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। ধনী পরিবারের সন্তান। রাজবালা গানের স্কুলে অন্নপূর্ণার সঙ্গে গৌরীর পরিচয়।
আমি সব কথা শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। গৌরী গান ভালোবাসে জেনে আমি যেন আরও রোমাঞ্চিত হলাম। তারপর থেকে গৌরীর সঙ্গে ভালো করে আলাপ করবো বলে আমার ভিতরটা উদ্বেলিত হতে থাকলো। দেরি যেন আর সয় না। সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ভাবলাম এবার যদি গৌরী আসে আমি তাকে গান শোনাবো। ভিতরকার মানুষটা অস্বাভাবিকভাবে ছেলেমানুষ হয়ে পড়েছে তখন। আমি বুঝেও যেন বুঝতে পারছি না। প্রহর গুনে চলেছি।
আমার মনে তখন রাতের জ্যোৎস্না, আর রাতের আকাশে তখন ভোরের আলো। গোটা রাত ধরেই গৌরীকে ভাবা। ভেবেই চলেছি।
সেদিন বোধ হয় ছিলো আমার ছুটির দিন। বাড়িতে আছি। হঠাৎ গৌরীর কণ্ঠস্বর আমার কানে এলো।
গৌরী এসেছে। নিজেকে শক্ত করে ওর সঙ্গে আজ ভালো করে আলাপ করবো বলে প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেলো। তাড়াতাড়ি হারমোনিয়াম টেনে আমি গান গাইতে শুরু করলাম। ভাবখানা এমন যেন সত্যিই আমি সংগীত সাধনায় রত। অবশ্য দরদ দিয়েই গান গাইছিলাম। গান গাইছি, কিন্তু দৃষ্টি পড়ে রইল আমার দরজার ওপরে। আশা, আমার গান শোনার জন্য গৌরী নিশ্চয়ই দরজার কাছে বরাবর আসবে।
আমি গান গেয়েই চলেছি। একটার পর একটা গান। অনেকগুলো গানই আমি তখন গেয়ে ফেলেছি। তবুও কই, গৌরী তো এলো না।
অত্যন্ত রাগ হলো। ভাবলাম ধ্যুৎ, হারমোনিয়াম তুলে রাখি। মনে হলো, এই মোহ ত্যাগ করা দরকার। ভাবলাম বড়লোকের দেমাগি মেয়ে সে। হয়তো আমাকে উপেক্ষা করাই তার বিলাস। ভাবলাম ওকে ভুলে যাওয়াই ভালো। মনে রেখে লাভ কী তাকে। কিছুতেই আমার মনের দর্পণে তার প্রতিচ্ছবি ভাসতে দেবো না বলে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম।
হলো না। কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। গৌরীর মুখটা ঠিক ঘুরে ঘুরে যেন আমার মনের পর্দায় এসে দাঁড়াতে লাগলো।
গৌরীকে বাড়ির বাইরে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অন্নপূর্ণা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। যতটা পারলাম গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, কী চাই?
কথাটা এমনভাবে বললাম যেন সব ব্যাপারটার জন্য অন্নপূর্ণাই দোষী।
সেও আকস্মিক এই পরিবর্তনে অনেকটা দমে গেলো। সেই মুহূর্তে সমস্ত উৎসাহ যেন তার হারিয়ে গেলো। তবুও যতটা সম্ভব সে নিজেকে সহজ করে বলল, দাদা-গৌরী বললে, তোর দাদার গানের গলাটা তো বেশ। ও তোমার সঙ্গে দেখা করবে, আলাপ করবে বলেছে।


আমি সেই কথা শোনা থেকে যেন কেমন হয়ে গেলাম। গৌরী আমার গানের তারিফ করেছে শুনে আমি সেই মুহূর্তে খুশিতে টলমল করে উঠলাম। আমি যেন একটু বেশিমাত্রায় ব্যাকুল হয়ে পড়লাম।
সেই ব্যাকুলতা নিয়েই আমি আছি। গৌরী তবু এলো না।
একদিকে সিনেমার নায়ক হবার অত্যুগ্র আকাক্সক্ষা, অন্যদিকে গৌরীকে পাবার ব্যাকুলতা আমাকে তখন রীতিমতো অস্থির করে তুলেছে। অনেক কষ্টে মনকে সান্ত¡না দিই। সান্ত¡না দিলাম এই ভেবে গৌরী ধনীর দুলালী, তাকে আশা করা দুরাশা মাত্র। তাই এই আমি গৌরীকে ভোলার চেষ্টা করলাম। তবুও হলো না। পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেও আমার মনের ওপর থেকে গৌরীকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। ওকে ভুলতে আমি আমার শিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে স্বার্থক করে তোলার জন্য আবার নতুন করে অভিযান শুরু করে দিলাম।
ভাবলাম ঘরে বসে থাকলে তো আর কেউ বাড়ি বয়ে এসে সুযোগ দেবে না।
সুযোগ পেতে হলে আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে পথে। যেমন করে হোক সুযোগ পেতে হবে আমাকে। সুযোগ যদি সহজে নাও আসে তা হলেও আমি আমার সঙ্কল্প থেকে এতটুকুও সরে আসবো না।
বেরিয়ে পড়লাম স্টুডিওপাড়ার উদ্দেশে। ভবানীপুর থেকে টালিগঞ্জ আর টালিগঞ্জ থেকে সাউথ সিঁথি রোড। অফিস করি আর বাকি সময়টা স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরি।
অনেক দিন আবার অফিস ফাঁকি দিয়েই বেরিয়ে পড়ি স্টুডিওপাড়ার দিকে।
যে ফাঁকি বিষয়টাকে আমি ছেলেবেলা থেকে ঘৃণা করতাম অফিসের বেলায় সেই ফাঁকিই দিতে শুরু করলাম।
আমার শিল্পীসত্তাকে সজীব করে তোলার জন্য, শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য কেরানি জীবনে এই ফাঁকির শুরু। আমি তখন মরিয়া হয়ে গেছি।
প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা স্টুডিওর গেট পর্যন্ত পার হতে পারি না।
সেখানে যে আমার প্রবেশ নিষেধ। তবুও আমি ছাড়ার পাত্র নই।




   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status