নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
ডামি নির্বাচন, দুর্নীতির সূচক ও দ্রব্যমূল্য
দিদারুল ভূঁইয়া
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবারসাম্প্রতিক সময়ে টিআইবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের থেকে আরও ২ ধাপ বেড়েছে। ওবায়দুল কাদের সাহেব সে রিপোর্ট উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, সব দেশেই দুর্নীতি হয়, অপবাদ দেয়া হয় কেবল আমাদের। এভাবে তিনি এবং তার সরকার দুর্নীতির পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিলেন। সামনের দিনে তাই দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে বলাইবাহুল্য। ৭ই জানুয়ারির ডামি নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। তারমধ্যে একটি হলো- নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে হঠাৎ করে গরুর মাংসের দাম প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যাওয়া। ঘটনা এখানেই শেষ হয় নাই। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম আবার প্রায় আগের জায়গায় চলে গেছে, এমনকি আগের জায়গাও ছাড়িয়ে গেছে। ২৭শে জানুয়ারির মানবজমিন’র রিপোর্ট মতে গরুর মাংসের দাম কোথাও কোথাও ১০০০ টাকা ছাড়িয়েছে।
এদেশে যেখানে বছর বছর সরকারি হিসাবে ৯-১৩ শতাংশ হলো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার, বেসরকারি হিসাবে অন্তত ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ; সেখানে গরুর মাংসের মতো প্রায় ‘লাক্সারি’ একটি পণ্যের দাম ২৫ শতাংশ কমে যাওয়া একটা বিশাল ঘটনা। আবার নির্বাচনের সময় সাধারণত গরুর চাহিদা বেড়ে যায়।
প্রায় ২ মাস পত্রিকাগুলো জুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কে কতো কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করেছেন, তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিবেদন বের হওয়া শুরু হলো। ভিডিও ব্লগাররা তাদের নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করলেন; রীতিমতো একটা হৈ হৈ কাণ্ড। বাঙালি মুসলমান যেমন শবেবরাতের দিন লাইন ধরে গরুর মাংস কিনেন, এ কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গায় এমন লাইনও দেখা গেছে। প্রায় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ।
এ উৎসবে ভাটা পড়েছে নির্বাচন শেষ হতে না হতেই। প্রায় সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো গরুর মাংসের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু হয়েছে। এখন কোনো কোনো ব্যবসায়ী তুলনামূলক কম দামে বিক্রির চেষ্টা করলে সিন্ডিকেট তাদের এমনকি হত্যার হুমকি দিচ্ছে বলে পত্রিকার খবরে এসেছে।
এ উথাল-পাতাল ঘটনা আসলে কী বোঝায়?
বাজার চাহিদা ও সরবরাহ সাধারণত কোনো দেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো মাফিয়াতন্ত্রের দেশে এ সত্য সত্য না। এ ফর্মুলা কাজ করে না। কখনো করে নাই। চাহিদা ও সরববাহকে ম্যানিপুলেট করে সরকারপক্ষের কিছু ব্যবসায়ী নামের সিন্ডিকেট এদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তারা কোনো পণ্যের দাম ৫০ থেকে কয়েকশ’ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এ সিন্ডিকেটের অংশ বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে পরিবহন সিন্ডিকেট, হাট বা আড়ত সিন্ডিকেট, ফড়িয়া সিন্ডিকেট, কুলি সিন্ডিকেট ইত্যাদি।
বগুড়া থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় আসতে তাকে অন্তত ৭টি স্থানে চাঁদা দিতে হয় বলে খোদ পুলিশের ২০২২ সালের রিপোর্টে উল্লেখ আছে। বর্তমানে এ সংখ্যা এবং প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলেই মনে হয়।
সরকার এবং সরকারের তল্পিবাহকরা মাঝে মাঝে বোঝাতে চায় এসব সিন্ডিকেট সরকারের অংশ নয়। বরং সরকারের বিরুদ্ধে এসব সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতার জন্য দায়ী। সরকার মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন ‘অভিযান’ চালায়। ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা-টরিমানা করেন। রমজানের আগে বিশেষ টাস্কফোর্স তৈরি হয়। তারা সাঁড়াশি অভিযান চালান। কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে সাজাও দেন। কিন্তু কখনোই সিন্ডিকেট ভেঙে দেন না, দ্রব্যমূল্যও মানুষের নাগালে আসে না।
সামপ্রতিক সময়ে টিআইবি’র রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের থেকে আরও ২ ধাপ বেড়েছে। ওবায়দুল কাদের সাহেব সে রিপোর্ট উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, সব দেশেই দুর্নীতি হয়, অপবাদ দেয়া হয় কেবল আমাদের। এভাবে তিনি এবং তার সরকার দুর্নীতির পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিলেন।
এসব সিন্ডিকেট সরকারি, রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি দলের কাছের লোকদের সিন্ডিকেট। একেবারে কুলি সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে ব্যাংক লুটের সিন্ডিকেট সকল সিন্ডিকেটের নিয়োগদাতা, রক্ষাকর্তা সরকার। তা যেই সরকারই হোক না কেন। বিএনপি’র আমলে বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগ।
এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকার ও সরকারি দল তার স্টেকহোল্ডারদের অসম্ভব পরিমাণ বিত্তশালী হতে, বিদেশে সম্পদ পাচার করতে সুযোগ করে দেয়, যাতে তাদের প্রয়োজনে বিরোধী দল ও মত দমনে ব্যবহার করা যায়। দলের ফান্ড পাওয়া যায়।
সংকটের মূল যেমন এখানে, সমাধানের পথও এখানে। নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটির সুযোগে এখানে সরকার বদলে ভোটের ভূমিকা এখন প্রায় শেষের দিকে। মানুষের ভোটের অধিকার বিনা ভোটের নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন এবং সর্বশেষ ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে এখন প্রায় নাই। এ ব্যবস্থার বদল লাগবে।
কেবল জনগণের ভোটে সরকার বদল হলেই দ্রব্যমূল্য অন্তত ২৫ ভাগ কমে যাবে। এ কথা এখন একেবারে হলফ করে বলে দেয়া যায়। আর যদি সরকার ও প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায়, বিশেষ করে অর্থবিল বা বাজেট, টাকা পয়সা খরচের জায়গায়; যদি দুর্নীতির অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার সত্যিকারের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে; এবং প্রয়োজনে এসব অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার (রিকল) ক্ষমতা জনগণের হাতে আনা সম্ভব হয়, দ্রব্যমূল্য অন্তত ৬০ ভাগ কমানো সম্ভব বলে মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে প্রতীয়মান হয়।
দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেশ কয়েক বছর ধরেই রাষ্ট্রের কেনা দামের প্রায় দ্বিগুণ। একটা ন্যূনতম জবাবদিহিতার সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। যেসব শিল্প পণ্য এদেশে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত অন্তত ৫ থেকে ১০ বার শুল্ক প্রদান করতে হয়। তাতে দিনশেষে ভোক্তার পকেট কাটা যায় বেশি। আবার আমদানি পণ্যের তুলনায় উৎপাদিত পণ্যকে অনেক বেশি শুল্ক প্রদান করতে হয়।
বিদ্যুৎ খাতের ‘উন্নয়ন’-এর নামে সরকার বিদ্যুৎমাফিয়াদের সিন্ডিকেটকে বেশির ভাগ সময় বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বৈধভাবেই দিচ্ছে। চাহিদা ছাড়াই অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করে যাচ্ছে। কম খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে, আমদানি করছে। ভারতের একটি কোম্পানি থেকে এভাবে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে সেদেশেও অনেক সমালোচনা, প্রতিবাদ হয়েছে। আর এভাবে সামগ্রিক উৎপাদন খরচ বেশি দেখিয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম ভোক্তাদের থেকে জবরদস্তিমূলক ভাবে নেয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে সমালোচনা করা হলে ‘সবকিছু বন্ধ করে দিব’ বলে হুমকি দিয়েছেন খোদ শেখ হাসিনা। আর এসবই সরকার করছেন তার মাফিয়া সিন্ডিকেটকে আইনত বৈধভাবে লুটপাট ও পাচারের সুযোগ প্রায় অবারিত করে দেয়ার জন্য।
শেখ হাসিনা উঠতে বসতে ইনডেমনিটি আইন করে তার বাবার হত্যার বিচারের পথ রহিত করা হয়েছিল বলে চোখের পানি ফেলতে থাকেন। আবার তিনিই বিদ্যুৎ খাতে ইনডেমনিটি আইন করেছেন। যাতে এ খাতের কোনো অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন করতে না পারে। মামলা করতে না পারে।
বলাইবাহুল্য কেবল বিদ্যুৎ খাতের ইমডেমনিটি তুলে দিলে বিদ্যুতের দাম অন্তত ৩০ ভাগ কমে যাবে। আর যদি বিদ্যুৎ খাতের প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছতা, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এখনো এদেশে বর্তমান মূল্যের তিন ভাগের একভাগ দামেই বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব। এদেশে এখনো বর্তমান মূল্যের তিন ভাগের এক ভাগ দামে পানি এবং গ্যাস সরবরাহ সম্ভব।
এদেশে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নামে একটি সাংবিধানিক পদ আছে। যার দায়িত্ব হলো সরকারের আয়-ব্যয়ের অডিট করা। সোজা কোথায় সরকারের চুরি ধরা। কিন্তু কার্যত এই পদে নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী এবং চাইলে তিনি এ পদধারীকে ছাঁটাইও করতে পারেন। তাহলে যার চুরি ধরার জন্য এই পদ, তিনিই এই পদে নিয়োগ দেন এবং ছাঁটাই করতে পারেন। তাহলে কার ঘাড়ে দুইটা মাথা যে নিয়োগকর্তার চুরি ধরবে? সেজন্য তিনি বরং সরকারের চুরিকে বৈধতা দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। এজন্যই এদেশে হাজার টাকার বালিশ, লক্ষ টাকার পর্দা সরকারিভাবে কেনা যায়। এবং সেজন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, কারও মামলা বিচার- সাজা হয় না।
অর্থবিল, বাজেট সহ কোনো কিছুতেই সরকার ও প্রশাসনের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা এদেশে কার্যকর নাই। যে কারণে এখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ দামে সর্বনিম্ন মানের ‘উন্নয়ন’ হয়। তার দাম চুকাতে হয় জনগণকে, বেশি বেশি ভ্যাট, ট্যাক্স, টোল দিয়ে। বেশি দামে পণ্য কিনে।
পৃথিবীর যেসব দেশ আমাদের মতো অবস্থা থেকে উন্নত, মানবিক, সভ্য, বসবাসের উপযোগী তালিকায় ভালোর দিকে, কম দুর্নীতি, কম লুটপাট, কম পাচারের বেশি নাগরিক সুবিধার, স্বাচ্ছন্দ্যের হয়েছে; তারা সবাই এসব সংকটের সমাধান করেই, এমন কয়েকটি সমাধানের উপায় অবলম্বন করেই আজকের জায়গায় গিয়েছে। আমাদের জন্য তাই একই চাকা নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে না। বরং তাদের সাফল্যগাথাগুলো থেকে আমাদের উপযোগী পথগুলো বেছে নিয়েই সমাধান যাত্রা শুরু করা সম্ভব। এবং অবশ্যই তার শুরু হবে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই। ডামি আন্দোলন বাদ দিয়ে সঠিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ডামি সরকারের পতন ঘটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
দিদারুল ভূঁইয়া
অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
ইমেইল: didarul.bhuiæ[email protected]
এদেশে ভালো মানুষের মূল্য নাই যারা তেল মারতে পারে দালালি করতে পারে তাদের মূল্য আছে
100% Right.