নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আসলে কি পেয়েছে?
দিদারুল ভূঁইয়া
১৮ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবারএকটা সঠিক নির্বাচনের দাবির, ভোটাধিকারের দাবির ঐক্যটাই আমাদের শক্তি, সাহস, আশা-ভরসার কারণ। এই ঐক্য যতদিন অটুট থাকবে, ততদিন আশা আছে। ভালোভাবেই আছে। দুইদিন আগে হোক কিংবা পরে, এদেশের মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পাবেই।
গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন, গুহা থেকে আন্দোলন পরিচালনা, ১২ জন মিলে ১০ সেকেন্ডের ঝটিকা মিছিল, বিদেশে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় সকাল-বিকাল সরকার ফেলে দেয়া, বিদেশিদের আশায় বসে থাকা এসব ডামি আন্দোলন নয়। ডামি আন্দোলন দিয়ে কিছু হবে না। বড়জোর তাকে ডামি নির্বাচনে বাধ্য করা যেতে পারে।
জনগণ এবং বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত বয়কটের মুখে শেখ হাসিনা ঘোষিত ডামি প্রার্থীদের নিয়ে যে নির্বাচন, জনগণ তার নাম দিয়েছে ডামি নির্বাচন। কেবল তাই না, ডামি এমপি, ডামি সংসদ, ডামি সরকার, ডামি ভোটার, ডামি বিরোধী দল- এ শব্দগুলো এখন বেশ শোনা যাচ্ছে। বাংলা ডিকশনারিতে নতুন কিছু শব্দ যুক্ত হলো।
মানুষ যখন সবচেয়ে হতাশ থাকে, ভবিষ্যৎ নিয়ে শূন্যতাবোধ করে, তখন এমন হাস্যরস করে নিজেকে একটু সহজ করার চেষ্টা করে; এটাই স্বাভাবিক। এসব হাস্যরস, আলাপ, সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে যে আশঙ্কাটা আস্তে আস্তে প্রবল হচ্ছে, তা হলো এই ডামি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন কি পুরোপুরি নির্বাসিত হয়েছে? আর কখনো এদেশের মানুষ নিজের পছন্দ মতো একটা ভোট দিতে পারবে?
ভোটাধিকার মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অধিকার। ভোটাধিকার থেকে অন্যান্য অধিকার প্রাপ্তির পথ উন্মুক্ত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছে যেসব কারণে, তার একটি ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা। একেবারে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই শুরু।
এদেশে এ পর্যন্ত ১২টি সাধারণ নির্বাচন হলেও কেবল ৩টি নির্বাচন নিয়ে মোটাদাগে বড় বিতর্ক শোনা যায় না। বাকি ৯টির প্রতিটি, দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত। এ ১২টি নির্বাচনের মধ্যে একটা জায়গায় খুব মিল পাওয়া যায়। দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া প্রতিটি নির্বাচন এখানে বিতর্কিত। আর অদলীয় (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে হওয়া ৩টি নির্বাচনের প্রতিটি তুলনামূলক ভাবে গ্রহণযোগ্য। এটা কোনোমতেই কাকতালীয় কিছু না। বরং এ তথ্য বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে।
এদেশের সরকারগুলো রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব বেশি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন- এমন দাবি হয়তো তারা নিজেরাও খুব কনফিডেন্টলি করেন না। কিন্তু ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, ম্যানিপুলেশনে, জালিয়াতিতে তারা প্রায় বিশ্বের বিস্ময়, রোল মডেল। বিনা ভোটের নির্বাচন, রাতের ভোটের নির্বাচন, ডামি নির্বাচন এমন কিছু পৃথিবীর কেউ আগে কখনো ভাবতে পেরেছেন, এমন জানা যায় না। সে হিসেবে এসব ইলেকশন জালিয়াতি একেকটা যেন ‘উদ্ভাবন’, একেবারে ‘আবিষ্কার’।
এসব আবিষ্কারের সুযোগ, নেশা, সক্ষমতা সরকারের এবারই শেষ, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। বরং সামনের দিনে আরও ‘উদ্ভাবনী’ সক্ষমতার পরিচয় তারা দিবে বলেই জাতির ভয়।
তার মানে কি বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন নির্বাসিত? আর কখনো মানুষ সত্যিকার অর্থে ভোট দিতে পারবে না? এদেশে আর কখনো একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না?
সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ জনতার চেয়ে বেশি শক্তিশালী, অজেয় আর কেউ হতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যখনই কোনো একটা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, শত প্রলোভন, ভীতি, নির্যাতনের মুখেও অটল থেকেছে, সেটা কখনো ব্যর্থ হয় নাই। সে প্রমাণের ফিরিস্তি নতুন করে দেয়ার দরকার নাই। সবাই সেগুলো জানি। সে থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি, জনতার ঐক্য সামনের দিনেও ব্যর্থ হবে না।
এবারের মতো গণঐক্য এর আগে বাংলাদেশে খুব বেশি হয় নাই। সারা পৃথিবীতেও সম্ভবত না, অন্তত বেশি একটা না। তেমন কোনো পিকেটিং না হলেও দুই মাসের বেশি হরতাল- অবরোধের পুরো সময়টাতে তেমন কোনো দূরপাল্লার বাস চলে নাই। শহরগুলোতেও গণপরিবহন ছিল অনেক অনেক কম। আর এই গণঐক্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয়েছে ভোটের দিন। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ভোটারশূন্য। একজন প্রথিতযশা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের মতে সারাদিনে ভোট দিয়েছেন কেবল ২ শতাংশ ভোটার। ভারতীয় একজন বিশ্লেষকের মতে ১০ শতাংশের কম। যেখানে আওয়ামী লীগের ৩০ শতাংশের একটা ভোটব্যাংক আছে বলে অনেকে বলতেন, এবারের নির্বাচন সেই খোদ আওয়ামী সমর্থকরাও বয়কট করেছেন।
সরকার অবশ্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে। নিজেদের নেতাদের দিয়ে ডামি প্রার্থী বানিয়ে, টাকা দিয়ে কিংস পার্টি বানিয়ে; ভয়, প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে কয়েকজনকে রাজাকার বানিয়ে, আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুন, হানাহানি বাধিয়ে; সামাজিক সুবিধার কার্ড আটকে রেখে, ভোটের দিন বিরিয়ানি, টাকার লোভ দেখিয়ে হেন কোনো চেষ্টা তারা বাদ রাখে নাই।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কড়াইল বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে আপনি ভোট দিয়ে এসে হাতে কালি দেখাবেন। তাহলে টিসিবি’র কার্ড রিনিউ হবে, না হলে হবে না। যাদের টিসিবি’র কার্ড নেই তারা আঙ্গুলে ভোটের কালি দেখাতে পারলে টিসিবি’র কার্ড করে দেয়া হবে বলেছেন’ (বিবিসি বাংলা, ৭ই জানুয়ারি ২০২৪)।
নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ অংশ প্রতিবাদে বলেছেন, ‘সরকার কৃপণতা করেনি, বরাদ্দের টাকা গেল কোথায়?’ (মানবজমিন, ১৫ই জানুয়ারি ২০২৪)। তার মানে এবার সরকার জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন করার জন্য টাকা দিয়েছে। সব বারই নাকি দেয়। এবার সে টাকার ভাগ অনেক প্রার্থীই পান নাই। না পেলেন তারা সংসদ সদস্য হতে, না পেলেন তারা টাকা- এটা তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে।
এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ ও সরকার সর্বোচ্চ ২-৫ শতাংশের বেশি ভোটার আনতে পারে নাই। সরকারের যদি ন্যূনতম লজ্জা, সংকোচ, বিবেক থাকতো, তাহলে তারা ইলেকশনের দিনই সরকার ভেঙে দিতো।
নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন দেশের সংস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ। ভারত, রাশিয়া, চীন সরাসরি নির্বাচনের প্রশংসা করেছে। অন্যদিকে আমেরিকা, বৃটেন, জাতিসংঘ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যৌথ বিবৃতিতে ৬টি আন্তর্জাতিক সংগঠন নির্বাচন বাতিল করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি তুলেছেন।
এসবই ঘটেছে কারণ বাংলাদেশের জনগণ ডামি নির্বাচন, ডামি সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই জায়গায় তারা অবিশ্মরণনীয় ঐক্যবদ্ধ আছে।
একটা সঠিক নির্বাচনের দাবির, ভোটাধিকারের দাবির এই ঐক্যটাই আমাদের শক্তি, সাহস, আশা-ভরসার কারণ। এই ঐক্য যতদিন অটুট থাকবে, ততদিন আশা আছে। ভালোভাবেই আছে। দুইদিন আগে হোক কিংবা পরে, এদেশের মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পাবেই।
গ্রেফতার এড়িয়ে আন্দোলন, গুহা থেকে আন্দোলন পরিচালনা, ১২ জন মিলে ১০ সেকেন্ডের ঝটিকা মিছিল, বিদেশে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় সকাল-বিকাল সরকার ফেলে দেয়া, বিদেশিদের আশায় বসে থাকা - এসব ডামি আন্দোলন নয়। ডামি আন্দোলন দিয়ে এই সরকারের পতন সম্ভব না। বড়জোর তাকে ডামি নির্বাচনে বাধ্য করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে লাগবে 'কজনকে জেলে ভরবি, আয়', 'তোর জেল কতবড়, দেখি' - এমন দুঃসাহস, এমন স্পর্ধা। গণ গ্রেফতারের পালটা হিসেবে স্বেচ্ছায় কারাবরণের লক্ষ্যে যেদিন আমরা রাজপথে সমবেত হতে পারবো, গণঐক্যকে এমন দুঃসাহসের জ্বালানী করতে পারবো - সেদিনই মুক্তি।
লেখক: অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
[email protected]
সংসদের মেয়াদ শেষ না হলে এবং রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে না দিলে সংসদ বিলুপ্ত হয় কীভাবে। একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯শে জানুয়ারি তাই একাদশ সংসদ চলমান থাকা অবস্থায় ৯ই জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ সদস্যদের গেজেট প্রকাশ, ১০ই জানুয়ারি শপথ গ্রহণ আবার ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন সংবিধানের সঙ্গে চরমভাবে সাংঘরষিক