নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
বিজয়ের ৫২ বছর পরও যে অঙ্কের উত্তর মিলছে না
রফিকুজজামান রুমান
১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার১৬ই ডিসেম্বর, বিজয়ের প্রথম প্রহর। পান্থপথ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর ফিরছিলাম। পৌষের মধ্যরাতে রাজধানীর রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি একটু কমই মনে হলো। তবু মন আলোড়িত হয়ে উঠলো খামারবাড়ি এসে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের পুরো শরীরজুড়ে লাল-সবুজের বর্ণালি আলো! একটু পরেই চোখে পড়লো জাতীয় পতাকার রঙে উদ্ভাসিত জাতীয় সংসদ ভবনের নান্দনিক সাজ। আর একটু এগিয়ে এলে গণভবনের সজ্জাটিও মুগ্ধতা-ছড়ানো। চারদিকের সাজ-সাজ রবই বলে দিচ্ছে কাল বিজয়ের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের ৫২ বছর!
এবারের বিজয় দিবস এমন এক প্রেক্ষাপটে উদ্যাপিত হচ্ছে, আর ক’দিন পরেই দেশের জাতীয় নির্বাচন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১২তম বারের মতো উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এই উদ্যাপন সর্বজনীন হয়ে উঠছে না বিএনপিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ না করার কারণে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়াও ১৪ দলীয় জোটের আসন বণ্টন নিয়েও এক ধরনের অস্বস্তি প্রকাশ করছেন জোটের শরিকরা। সাতটি আসন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলেও তাতে তারা খুশি নন। এই নিয়ে দর কষাকষির মধ্যেই জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি বরাবরের মতোই রহস্যঘেরা। বেশ কিছুদিন ধরেই জিএম কাদের আড়ালে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণাও তিনি দেননি। দিয়েছেন মহাসচিব। প্রধানমন্ত্রী নিজেই শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নির্বাচনে থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষদিন অর্থাৎ ১৭ই ডিসেম্বরের পরে হয়তো অনেককিছুই স্পষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত যে সমীকরণেই সমাধান খোঁজা হোক না কেন, এটি স্পষ্ট যে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ তার পথ হারিয়েছে। ’১৪ এবং ’১৮ এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আওয়ামী লীগকে যে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল, সেখান থেকে উত্তরণের পথে না হেঁটে তারা বরং সমস্যা আরও ঘনীভূত করছে। এবারের নির্বাচনটিও যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত হবে হয়তো; রাজনৈতিক দল হিসেবে তার পরাজয়ের পাশাপাশি দেশের আসন্ন সংকটের জন্যও ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতে হবে। এভাবে একটি দেশের নির্বাচন হয় না। আওয়ামী লীগ জানে কী হতে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন জানে কীভাবে হতে যাচ্ছে, জনগণ জানে- ভোট দিতে যাক বা না যাক, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকছে। তাহলে এসব নাটক মঞ্চায়নের মানে কী? ‘বিরোধী’ দল সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করছে তাদেরকে কয়টি আসনে বিজয়ের নিশ্চয়তা দেয়া হবে! এমন নির্বাচন এই ধরাধামে সত্যিই বিরল!
অথচ আজ যে বিজয় দিবস উদ্যাপন করছি, ৫২ বছর আগে যে বাংলাদেশের জন্ম, তার মূলেও ছিল নির্বাচন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তার ১৬৭টি আসনের বিপরীতে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ৮৮টি আসন। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। জনরায়কে উপেক্ষা করে ভুট্টো ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। জনগণ ফুসে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে সে ক্ষোভ পরিণত হয় মুক্তি-আন্দোলনে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। তার মানে, নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার মধ্যেই বাংলাদেশের মুক্তি-আন্দোলনের সূত্রপাত। নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে কী হতো সে আলোচনা এখন হয়তো প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু নির্বাচন ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। ’৭০ এর সেই নির্বাচন এর ফলাফল নিয়ে কোথাও কোনো প্রশ্ন উঠেছিল বলে শোনা যায়নি। পাকিস্তানের একটি স্বৈরশাসনের অধীনেও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি বলেই মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রাণের বাংলাদেশে ৫২ বছর পরেও নির্বাচন নিয়েই দ্বিধাবিভক্ত জাতি! সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন-পদ্ধতি আজও অধরা। ‘ডামি’ প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনকে অংশ্রগহণমূলক করার প্রচেষ্টা। তাহলে আমরা কতোটুকু আগালাম? ৫২ বছরে আমাদের অর্জন কী? কোনো সন্দেহ নেই, উন্নয়ন হয়েছে। চারদিকে উন্নয়নের উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ভোটাধিকার তো সবার আগে। ’৭০-এ মানুষ তো তবু ভোট দিতে পেরেছিল। এখন? ভোট কেন্দ্রে না যেতে হুমকি। মৃত মানুষের ভোট প্রদান। দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দেয়ার ‘অপরাধে’ ধর্ষণ-খুন। ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩ ভোট। কতোটুকু আগালাম?
ছেলেবেলায় অঙ্ক করেছিলাম। একটি তৈলাক্ত বাঁশে একটি বানর এক মিনিটে পাঁচ ফুট উপরে ওঠে। আবার পরবর্তী মিনিটে দুই ফুট নিচে নেমে যায়। তাহলে ২৫ ফুট উঁচু বাঁশের মাথায় উঠতে বানরের কতো সময় লাগবে?
আমরা পদ্মা সেতু দিয়ে পাঁচ ফুট উপরে উঠি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে মহাকাশ ছুঁই, মেট্রোরেল দিয়ে আরও পাঁচ ফুট উপরে উঠি, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি দিয়ে আরও উপরে উঠি; কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পেরে যে দুই ফুট নিচে নেমে যাই, তাতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পেতে আমাদের আর কতো সময় লাগবে?
ছোটবেলায় বানরের অঙ্কটির উত্তর পেয়েছিলাম। বড়বেলায় বাংলাদেশ নামের অঙ্কটির উত্তর আজও মিলছে না। ২০০৮ এর পরে এদেশের কোটি তরুণ এখনো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের কাছেও বাংলাদেশ এক দুর্বোধ্য ‘অঙ্কের’ নাম।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক