প্রথম পাতা
সওজের ৯০ বিঘা জমি স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার কব্জায়
শরিফ রুবেল, কাশিমপুর, গাজীপুর থেকে ফিরে
৬ মে ২০২৪, সোমবারনবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক। মাঝে চক্রবর্তী বাসস্ট্যান্ড। একটু হেঁটেই কাশিমপুর নবী টেক্সটাইল এলাকা। ৫ মিনিটের পথ। হাতের বাম পাশে বিশাল ময়লার ভাগাড়। ডান পাশে শত শত স্থাপনা। পদ্মা হাউজিং প্রকল্প। জ্যোতি ফিলিং স্টেশন। আরও কতো কি। দক্ষিণ কোণে অল্প কিছু ফাঁকা জায়গা।
তবে পদ্মা হাউজিংয়ের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম পাঠান মানবজমিনকে বলেন, দখল নয়। আমরা পদ্মা বহুমুখী সমবায় সমিতির ক্রয়সূত্রে এই সম্পত্তির মালিক। আমরা স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে এই জমি কিনেছি। কারও জমি দখল করিনি। কিন্তু সড়ক বিভাগ বলছে এই জমি তাদের। তারা নোটিশ ছাড়াই আমাদের স্থাপনা ভেঙে ফেলেছে। এটা অন্যায় করেছে। আমরা ৮৫ দাগের সম্পত্তি কিনেছি। ওই দাগেই আছি। অন্য দাগে যাইনি। কিন্তু সড়ক বলছে আমরা ৮৩,৮৪,৮৫,৮৬,৮৭,৮৮ দাগের জমিও দখল করেছি। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। অধিগ্রহণ ও রাষ্ট্রপতির গেজেট হলে সম্পত্তি কীভাবে পদ্মা দাবি করতে পারে। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে যেকোনো সম্পত্তি নিতে পারে। গেজেট হলে ওই সম্পত্তি অন্য কেউ নিতে পারবে না। এটা সত্য।
পানিশাইলের একজন বাসিন্দা মানবজমিনকে বলেন, সওজের যত জমি দখল হয়েছে সবকিছুর পেছনে এই আরিফ জড়িত আছে। তার ইশারা ছাড়া এই এলাকায় কিছু হয় না। আর সড়ক বিভাগ সবচেয়ে বেশি জমি অধিগ্রহণ করেছিল এই আরিফের পরিবারের কাছ থেকে। তাই জমির সব ফাঁকফোকর তার জানা আছে। রেকর্ড সংশোধনও তিনি করেছেন। এই কাজে তাকে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার আলমও সহায়তা করেন।
অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রউফ আরিফ মানবজমিনকে বলেন, কিসের দখল। আমি জমি দখল করেছি এটা আপনার থেকেই প্রথম শুনলাম। আমি কারও জমি দখল করিনি। আমরা বাপ-দাদার জমি ভোগদখল করছি। এখানে সড়কের কোনো জমি নেই। বরং সড়কই গোপনে তাদের জমি অন্যদের দিয়ে দিচ্ছে। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে থাকে সেটা পুরোটাই মিথ্যাচার। আমি আওয়ামী লীগ করি। কারও জমি দখল করা আমার কাজ নয়। আর আমি কারও দখলে সহায়তা করি নাই। কেউ এটা বললে সে আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সওজের একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, পদ্মা হাউজিং জমি কিনেছে ৮৫ দাগে ১ একরের মতো। সেটাও ভুয়া কাগজ। কিন্তু ভুয়া কাগজ দিয়েই তারা আশপাশের আরও ৫টি দাগের অন্তত ৬ একর জমি দখল করে নিয়েছে। দখল করা জমি তারা প্লট করে বিক্রি করে দিয়েছে। সেখানে বহু বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা হাউজিংয়ের মালিক মিরপুরের। তিনি এখানে এসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রউফ আরিফের সহায়তায় এই দখলবাজি করেন। ওই হাউজিংয়ে দু’জনের মালিকানা রয়েছে। সওজ নানা চেষ্টা করেও আরিফের ক্ষমতার কাছে পরাস্ত হয়েছে। আরিফ শত শত লোক জমা করে সওজের লোকদের ওপর হামলে পড়ে। এজন্য জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার সড়ক জনপদের এই অঞ্চলের প্রধানও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাই জমি উদ্ধারে আমাদের বাধার মুখে পড়তে হয়।
সওজ সূত্র মতে, নবীনগর-চন্দ্র মহাসড়ক নির্মাণের কাজে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড তৈরি করতে ১৯৬৭ সালে গাজীপুর কাশিমপুর উপজেলায় দক্ষিণ পানিশাইল মৌজায় ৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। ১৯৬২ সাল থেকে ’৬৭ সাল পর্যন্ত ৩ ধাপে ২৬টি দাগে ৩০ জন মালিকের কাছ থেকে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণ শেষে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি পাঠালে রাষ্ট্রপতি তখন ওই জমি সরকারের অনুকূলে গেজেট জারি করেন। তখনই জমি বুঝে নেয় সড়ক ও জনপদ বিভাগ। পরে প্রায় ৯০ বিঘা জমি সীমানা শনাক্ত পিলার স্থাপন করে দখলে নেয় সওজ। দীর্ঘদিন ধরেই সড়ক নির্মাণের কাজের মালামাল ও নির্মাণযন্ত্র এই জমিতে রেখে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালায় সওজ। কিন্তু সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৮৫ সালে ওই জমি থেকে মালামাল সরিয়ে নেয় সওজ। এরমধ্যে ভূমি জরিপ আরএস জরিপ শেষ হলেও খোঁজ রাখেনি সওজ। এই সুযোগে বিক্রি করা জমি কৌশলে নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেন বিক্রীত মালিকরা। পরে কয়েক বছর জমিটি অরক্ষিত পড়ে থাকলেও খোঁজ নেয়নি সওজ। ১৯৮৮ সালে এই জমি বেদখল শুরু হয়। যে যেভাবে পেরেছে দখলে নিয়েছে এই সম্পত্তি। ১৯৯০ সালের পরে স্থানীয় দাতা ব্যক্তিরাও ওই জমি পুনরায় দখলে দিতে শুরু করে। নির্মাণ করেন বাড়িঘর। কেউ কেউ অন্যত্র বিক্রিও করেন। খবর পেয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগ জমি দখলমুক্ত করতে বার বার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এলাকাবাসীর বাধার মুখে বার বার ফিরে আসতে হয় সওজকে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২০শে মার্চ প্রায় ৫ একর জমি দখলমুক্ত করে সওজ। কিন্তু আবারো বাধার মুখে পড়ে ফেরত আসতে হয়।
সরজমিন দেখা গেছে, দক্ষিণ পানিশাইল মৌজায় ৮৩,৮৪,৮৫,৮৬,৮৭,৮৮ নং দাগে প্রায় ৬ একর জমি দখল করে পদ্মা হাউজিং নামে একটি সোসাইটি তৈরি করা হয়েছে। ৮৫ দাগের উপর উচ্চ আদালত থেকে একটি স্থিতাবস্থা এনে আরও ৬টি দাগের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছে চক্রটি। পদ্মা হাউজিং বহুমুখী সমবায় সমিতির ২১৩টি প্লট আছে। এসব প্লটে সারিবদ্ধভাবে অন্তত ১১৩টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশে কিছু টিনশেড বাড়িও আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমির মালিকানা ও বৈধ কাগজপত্র না থাকায় উক্ত জমিতে ভবন নির্মাণে ব্যাংক লোন নিতে পারেনি মালিকরা। এতে প্রায় প্রতিটি বাড়িই অর্ধনির্মিতভাবে পড়ে আছে। কিছু কিছু বাড়ির ছাদ নির্মাণ হলেও বাউন্ডারি করতে পারেনি। দখলকৃত ৬ একর জমির প্রায় পুরোটাই স্থাপনায় ঠাসা। লম্বা সরু রাস্তা রেখে দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু কিছু বাড়িতে হোল্ডিং নম্বর দেখা গেলেও হাউজিংয়ের ৯০ শতাংশ বাড়িই হোল্ডিং নম্বরবিহীন। সূত্র জানায়, জমি নিয়ে সওজের সঙ্গে বিরোধ ও মালিকদের বৈধ কাগজপত্র না থাকায় হোল্ডিং নম্বর দেননি স্থানীয় কাউন্সিলর। হোল্ডিং নম্বর না থাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পেতেও ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে।
সম্পত্তি আরও যারা দখলে রেখেছে: নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চক্রবর্তী এলাকায় সড়ক ও জনপদ বিভাগের ৩৬ একর জমি বিভিন্ন জনে দখলে নেন। এরমধ্যে বিএনপি’র সাবেক এমপি নুরুল হুদার ছেলে তানভির হুদা দখল করে রেখেছে ৪ একর জমি। মহাসড়কের পূর্ব পাশে শেষ সীমানায় একটি বেসরকারি ব্যাংক দখল করে রেখেছে ২ একর জমি। দখলের পরে বাউন্ডারি দেয়ার চেষ্টা করলে সওজের বাধায় তা ব্যর্থ হয়। পদ্মা হাউজিংয়ের রাস্তার পশ্চিম পাশে ৪ একর জমি স্থানীয় এলাকাবাসী দখল করে রেখেছে। সেখানে বাড়িঘর নির্মাণ করে ভোগদখল, কেউ কেউ আবার দখলের পরে একাধিকবার বিক্রিও করেছেন। এক জমির একাধিক মালিকের হাতবদল হয়েছে।
কাশিমপুর দক্ষিণ পানিশাইল মৌজার নিম্নোক্ত দাগের জমি অধিগ্রহণ করে সওজ। ৩ নং দাগে জমির পরিমাণ ৫৮ শতাংশ। ৪ নং দাগে ৪৪ শতাংশ। ৫ নং দাগে ২ শতাংশ। ১৩ নং দাগে ২ শতাংশ। ১৪ নং দাগে ৩ একর। ১৫ নং দাগে ১৪ শতাংশ। ১৭ নং দাগে ২১ শতাংশ। ১৮ নং দাগে ৩ শতাংশ। ২৮ নং দাগে ৩৬ শতাংশ। ৩৮ নং দাগে ৩৪ শতাংশ। ৩৯ নং ২৩.৬ একর। ৪০ নং দাগে ১৪ শতাংশ। ৪৩ নং দাগে ৬ শতাংশ। ৪৬ নং দাগে ১৮ শতাংশ। ৪৮ নং দাগে ৩ শতাংশ। ৪৯ নং দাগে ৯৪ শতাংশ। ৫০ নং দাগে ৩ শতাংশ। ৫১ নং দাগে ৫ শতাংশ। ৫২ নং দাগে ১০ শতাংশ। ৫৩ নং দাগে ৪২ শতাংশ। ৫৪ নং দাগে ৬১ শতাংশ। ৫৫ নং দাগে ১৭ শতাংশ। ৫৬ নং দাগে ৫৫ শতাংশ। ৫৭ নং দাগে ৫১ শতাংশ। ৫৮ নং দাগে ৯৫ শতাংশ। ৫৯ নং দাগে ১.৩০ একর। ৬০ নং দাগে ১৩ শতাংশ। ৬৯ নং দাগে ১২ শতাংশ। ৭০ নং দাগে ৩৭ শতাংশ। ৭১ নং দাগে ১০ শতাংশ। মোট ৩০ দাগে ৩৫ একর ২৮ শতাংশ।
দখলকরা জমিতে করা একটি বাড়ির মালিক হাবিবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমরা পদ্মা হাউজিংয়ের কাছ থেকে প্লট কিনে বাড়ি করেছি। তারা আমাদের দলিল করে দিয়েছে। এখন জমি তাদের নাকি সড়ক বিভাগের তা জানা নেই। সড়ক উচ্ছেদ করতে আসলে আমরা বিষয়টি হাউজিংকে জানিয়েছি। তারা কোনো সমাধান দিতে পারেনি। আরেক বাড়ির মালিক খাইরুল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, জমি যদি সড়ক বিভাগের হয় তাহলে আমাদের এই ক্ষতিপূরণ দিবে কে? সড়ক বিভাগ আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দিচ্ছে। আমরা এর কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।
স্থানীয় কাউন্সিলর আব্দুস সালাম আহমেদ আব্বাস মানবজমিনকে বলেন, আমি কোনো দখলের পক্ষে নেই। তবে আমরা যেহেতু জনপ্রতিনিধি তাই কারও বাড়িঘর ভেঙে দিলে আমরা তাতে সমর্থন দিতে পারি না। সওজের জমি তারা উদ্ধার করে নিক। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে এ কাজে আমি সরাসরি সহায়তা করতে পারি না। কারণ আমি জনপ্রতিনিধি। আমি দুই পক্ষের কারও পক্ষেই থাকতে চাচ্ছি না। তবে সরকারি জমি উদ্ধার হোক এটা আমিও চাই। সেটা নোটিশ দিয়ে করতে হবে।
সওজ মানিকগঞ্জ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে সড়ক বিভাগ মানিকগঞ্জ অঞ্চলের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. শহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, সড়কের দখল হওয়া জমির কিছু অংশ আমরা উদ্ধার করেছি। বাকিগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এখনো বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বেদখল আছে।
এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে করে কেউ সরকারি জমি অন্যায় ভাবে ভোগদখল করার সাহস না পায়।
fake news.01881510795
জমি সওজের বুঝলাম। কিন্তু দেশটা কার?
এদেশ তাদের । তাই তারা দখল করলে কারও কিছু করার নেই।
ধন্যবাদ সুন্দর নিউজ করার জন্য। আমরা চাই জায়গা উদ্ধার হোক। তবে আমি মনে করি নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার আলম না চাইলে জমি উদ্ধারের কাজ চলমান হতো না।
সওজের জমি সহজে দখল।
'ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩' অনুসারে এদের জেলে থাকার কথা।
সওজের ৯০ বিঘা জমি স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার কব্জায় : আইনের দেশে এগুলা হয়,সাথে ঘুষ আছে এর সাথে অনেকেই জড়িত।