প্রথম পাতা
সিপিডি-নাগরিক প্ল্যাটফরমের সংলাপ
৩ চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৬ মে ২০২৪, সোমবারবেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আসন্ন বাজেট একটি জটিল পরিস্থিতিতে প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। গত বাজেটে সমস্যা ছিল একটি। এবার যুক্ত হবে তিনটি। এগুলো হলো- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের ঋণই সরকারের পরিশোধ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে এবং জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হচ্ছে কর আহরণ কম হওয়ার কারণে। এসব সংকট অর্থনীতিকে ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো নির্মূল করার জন্য কর্মসংস্থান, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে ফোকাস করা উচিত।
গতকাল রাজধানীর হোটেল লেকশোরে সিপিডি’র উদ্যোগে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় ‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক একটি নীতি সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ, সরকারের নীতিনির্ধারক, জনপ্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য দেন।
সংলাপে আলোচকদের দাবি, একদিকে প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে। এটা টেকসই উন্নয়নের লক্ষণ নয়। দু’বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। এতে চাপে স্বল্প আয়ের বিপুল মানুষ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি সমস্যা যোগ হয়েছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এটি এখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ঋণের ঝুঁকি বাড়ছে। এ ঋণ শুধু বিদেশি ঋণ না, অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিখাতের ঋণের দায়-দেনাও বাড়ছে। তৃতীয়ত, দেশের প্রবৃদ্ধির হার শ্লথগতির হয়ে পড়েছে। এটি হয়েছে কর আহরণ কম হওয়ার কারণে, এ খাত না বেড়ে আরও সংকুচিত হয়েছে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি বিরূপভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে গৃহীত উদ্যোগ কাজ করছে না বলেও জানান তিনি। এই সমস্যা মোকাবিলা করেই আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ জোরদার করার তাগিদ দেন দেবপ্রিয়। আর এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অসম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি।
জিডিপিতে ঋণের বোঝা আরও বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের যে সুনাম ছিল আমরা কখনো খেলাপি হই না, সে সুনাম আর থাকছে না। ইতিমধ্যে আমরা ৫ বিলিয়ন ডলারের দেনা এখনো দিতে পারছি না। আমাদের গর্বের জায়গায় চিড় ধরেছে। জিডিপিতে সরকারি ঋণ ৩৭ শতাংশ, ব্যক্তিখাতের ঋণ ৫ শতাংশ- সবমিলিয়ে ৪২ শতাংশ ঋণের বোঝা আছে সরকারের।
জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হবে জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, সরকার ত্রৈমাসিক জিডিপি’র তথ্য দিচ্ছে। তাতে যা দেখা যাচ্ছে, গড় প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বাকি সময়ে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি করতে হবে- যা প্রায় অসম্ভব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজেট প্রত্যাশা নিয়ে জরিপ করেছে সিপিডি। এতে আড়াই হাজারের ওপর অংশগ্রহণকারী ছিল। জরিপের তথ্য তুলে ধরেন দেবপ্রিয়। জরিপের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ৮৯ শতাংশই বর্তমান সরকারের বাজেট বিষয়ক উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করছে বলে মনে করে সিপিডি এবং এসডিজি অর্জনে নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশ। তবে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতারই বাজেট সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই বলে দুই সংস্থার একটি যৌথ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বিষয়টিকে তিনি কিছুটা বিপরীতমুখী অবস্থান হিসেবে মন্তব্য করেন।
এতে তিনটি বিষয় পরিষ্কার। তারা শোভন কর্মসংস্থান চায়, মানসম্মত শিক্ষা চায়, সমপ্রসারিত সামাজিক সুরক্ষা চায়। তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করতে হবে। আর স্বাধীন মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। জরিপের বেশির ভাগ মানুষ বলছেন, স্বচ্ছতার জন্য পেনশন ফান্ডকে আলাদা করতে হবে, সামাজিক সুরক্ষায় যোগ করা যাবে না।
বাজেট সম্পর্কিত সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রম জোরদার করা উচিত বলে মনে করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান।
জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি কমিটির সদস্য এ. কে. আজাদ এমপি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি এসব অর্থের যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা না যাবে ততদিন পর্যন্ত বরাদ্দ বাড়িয়েও কোনো কাজে আসবে না।
তার নির্বাচনী এলাকার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একটি রাস্তা সংস্কারের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধির তিন লাখ টাকা দাবির বিপরীতে ১ লাখ দিতে চাইলেও ওই প্রতিনিধি নিতে চাননি। তবে পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওই রাস্তা ৩০ হাজার টাকা দিয়েই সংস্কার সম্ভব। সরকারি টাকার এ ধরনের অপচয় রোধের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালকেও দুর্নীতিমুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটাতে হবে। যারা কর দিচ্ছে তাদের ওপরই কর চাপানো হচ্ছে। তারা অনেক সময় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেকে কর দিচ্ছেন না, কর ফাঁকি দিচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশে টাকা চলে যাচ্ছে। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। বাজেটে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয় না।
কেয়ারের পরিচালক টনি মাইকেল বলেন, সুপেয় পানি মানুষের মৌলিক চাহিদা। খুলনা, সাতক্ষীরা ও টেকনাফে পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। নাগরিকদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা উচিত রাষ্ট্রের। আমরা এখনো ইথিওপিয়া কিংবা নাইজার হয়ে যাইনি যে, আমাদের মানুষকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে ৫-৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি কমিটির সদস্য এ. কে. আজাদ এমপি, নাগরিক প্ল্যাটফরমের কোর সদস্য ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।