শরীর ও মন
পায়ুপথের সংকটজনক রোগ এনাল ফিশার
ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
৭ এপ্রিল ২০২৪, রবিবারএনাল ফিশার হলো পায়ুপথের অন্যতম একটি রোগ। এ রোগে মূলত পায়ুপথ ছিঁড়ে যায়।
চিকিৎসা দিতে গিয়ে দেখা যায় প্রতি ১০০ জনে এক দু’জন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এনাল ফিশার রোগে ভোগেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সের নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মলদ্বার সামনের দিকে ফেটে যেতে পারে।
কারণ:
কোষ্ঠকাঠিন্য এই রোগের প্রধান কারণ। তবে অতিরিক্ত ডায়রিয়া হলেও এনাল ফিশার হতে পারে। মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। সাধারণত মলদ্বারের পেছন দিকে ফাটা অথবা ঘা হয়ে থাকে। মলদ্বারের টিবি, যৌনবাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণেও অনেক সময় মলদ্বারের পাশে ঘা দেখা দেয়। এই রোগের প্রধান উপসর্গ ব্যথা।
প্রকারভেদ:
এনাল ফিশার দুই ধরনের হয়ে থাকে।
১. হঠাৎ সংকটজনক হয়ে ওঠা ফিশার (Acute Fissure):
তীব্র ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। মলত্যাগের পরপর এই ব্যথা শুরু হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ব্যথা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে জ্বালাপোড়া হতে থাকে। ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে এতটাই তীব্র হয় যে, অনেক রোগী বাথরুমে যেতে ভয় পান। এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত কম। বেশির ভাগ রোগী অভিযোগ করেন মলত্যাগের পর টিস্যু ব্যবহার করলে রক্ত দেখা যায়। অল্পকিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। মলদ্বারে শ্লেষ্মা বা পিচ্ছিল পদার্থ যেতে পারে।
২. দীর্ঘস্থায়ী ফিশার (Chronic Fissure):
ছয় সপ্তাহের বেশি ফিশারকে দীর্ঘস্থায়ী ফিশার বলা হয়। দীর্ঘস্থায়ী ফিশারে ব্যথা অল্প কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা নাও হতে পারে। অধিকাংশ রোগী মলদ্বারের পাশে বাড়তি মাংস (Sentinel Piles) আছে বলে অভিযোগ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মলদ্বারের ভেতরেও বাড়তি মাংস (Hypertrophied Anal Papilla) থাকতে পারে। অনেক সময় রোগীরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর মলদ্বারে ব্যথা অথবা জ্বালা, মলদ্বার সামান্য ভেজা ভেজা অথবা মলদ্বারে চুলকানি অনুভব করেন।
দুই ধরনের ক্ষেত্রেই ফিশার সংক্রমিত হয়ে ফোঁড়া (Abscess), পুঁজ পড়া কিংবা ফিস্টুলা হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেকে প্রসাবের সমস্যায় এবং নারীরা অনেকে যৌন মিলনের সময় ব্যথা অনুভব করেন।
রোগ নির্ণয়:
রোগীর উপসর্গ শুনে এবং মলদ্বার পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করে থাকেন। মলদ্বার না দেখে শুধুমাত্র শুনে চিকিৎসা করা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। কেননা মলদ্বার দেখেই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন যে, রোগীর মলদ্বারের টিবি, যৌনবাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণে হওয়া ফিশার নির্ণয়ে রোগীর অন্য কোনো পরীক্ষা (সিগময়ডোস্কোপি/কোলনস্কোপি) প্রয়োজন কিনা।
প্রতিরোধ:
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। প্রতিরোধের জন্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা যেতে পারে। কেননা দীর্ঘদিন ভোগার কারণে মলদ্বার সংকুচিত হয়ে যায় এবং মলদ্বারের পাশে মাংস বেড়ে (Sentinel Piles) যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা।
অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস ত্যাগ করা।
বারে বারে মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করা।
নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন।
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করা।
ডায়রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া।
চিকিৎসা:
প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানো সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় পরিমিত (ঈড়হংবৎাধঃরাব) চিকিৎসায় ফিশার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। পরবর্তী সময়ে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় অল্প ব্যথা এবং রক্তপাত হয় বিধায় অধিকাংশ মানুষ বিষয়টি অবহেলা করেন। সিজ বাথ (ঝঃরু ইধঃয) এবং আঁশজাতীয় খাবার বেশি করে গ্রহণ করে রোগীরা উপকার পান। এক গামলা পানিতে সামান্য লবণ বা পভিসেপ দ্রবণ মিশিয়ে মলত্যাগের পর ১০ থেকে ১৫ মিনিট নিতম্ব ডুবিয়ে বসে থেকে সিজ বাথ নেয়া যায়।
সার্জিক্যাল চিকিৎসা:
এ রোগের জন্য অপারেশন করতে হতে পারে এ কথা শুনলেই রোগীদের আত্মা শুকিয়ে যায়। এমনকি বায়ু বের করতেও কষ্ট হয়। ওষুধে না সারলে অপারেশনই এই ঘা শুকাবার একমাত্র পথ এবং তারপরই সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কলোরেক্টল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ইমেইল:[email protected] www.facebook.com/Dr.Mohammed TanvirJalal
ফোন: ০১৭১২৯৬৫০০০৯